অবন্তিকা আমার মেয়ে হতে পারতো, ওর বাবাও শিক্ষক ছিলেন
ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুতে ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ ছিলাম সকাল থেকেই। সন্ধ্যায় ঢাকায় এসে প্রথমেই যেটা জানলাম সেটা হল, অবন্তিকা আমাদের মেয়ে, আমার প্রথম জীবনের সহকর্মী ও বন্ধু প্রয়াত অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের মেয়ে। অবন্তিকার জন্মেরও বহু আগে আমি আর জামালের পরিবার পাশাপাশি বাসায় থাকতাম কুমিল্লার দেবিদ্বারে। জামাল ফিজিক্স পড়াত, আমি ফিলসফি।
সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। আমরা কয়েকজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী শিক্ষক দেবিদ্বার সরকারি কলেজে জয়েন করেছিলাম। টগবগে সব তরুণ, আর চারপাশে নকলের মহোত্সব। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নকল রূখতে হবে।
কিন্তু রূখবে কে? প্রবীণ সহকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ফলে লড়াইটা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। আমাদের কলিগরা রাস্তাঘাটে আক্রান্ত হলেন, বাসা ভাঙচুর হল, কলেজ ক্যাম্পাসেও আক্রমণের শিকার হতে হল। জামালের গায়ে ঢিল পড়ল, বাচ্চুকে মারতে আসল আধলা ইট নিয়ে, তারেক আজিজকে হুমকি ধামকি দেয়া হল, আমার বাসায় কাঁচ ভেঙেচুরে দেয়া হল রাতের বেলায়।
প্রবীণ সহকর্মীরা কোন সহযোগিতা করতেন না, বরং বাঁকা হাসি দিতেন। একজন আমাকে বললেন, বাছুরের শিং গজাইলে সবখানেই গুঁতা মারে। এখন বুঝবেন!
বছর দুয়েকের লাগাতার চেষ্টায় দেবিদ্বার সরকারি কলেজকে প্রায় নকল-শূন্য করতে পেরেছিলাম। খুব কঠিন কাজ ছিল সেটা। অলমোস্ট সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মত। কারণ মানুষের পারসেপশনে নকল করাটা অনেকটা "অধিকার" এর মত ছিল। আর নকল ধরাটা ছিল "ডিস্টার্ব"! অন্যত্র অনেক নীতিবান এমন অনেক মানুষকেও এভাবে ভাবতে ও বলতে দেখেছি।
অবন্তিকার বাবা অধ্যাপক জামাল খুব প্যাশনেট শিক্ষক ছিলেন। টিভিতে অবন্তিকার মা অর্থাৎ আমাদের ভাবীর চেহারা দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কি যে হাসিখুশি আর অতিখিপরায়ন পরিবার ছিলেন তারা! তাদের সোনার টুকরা মেয়ে অবন্তিকা। ছোটবেলা থেকেই দারুণ চটপটে ছিল। ক্রমাগত হয়রানির শিকার হতে হতে আজ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। যাদের লাগাতার হয়রানির কারণে সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই তালিকায় একজন শিক্ষক তথা প্রক্টরও আছেন!
অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের মৃত্যুটাও মর্মান্তিক। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা দেবিদ্বার কলেজকে নকলশূন্য করেছিলাম, জামাল সেখান থেকে সরে আসেন নি। বছর কয়েক আগে এক নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি অবৈধ ভোটের প্রক্রিয়া রূখতে গিয়েছিলেন। বেধড়ক মারা হয় তাকে। সেই যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর সুস্থ হতে পারলেন না। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় গত বছর মৃত্যু হয় তার।
অবন্তিকাও বাবার এই স্বভাবটা পেয়েছিল। প্রতিবাদ করার স্বভাব। অত্যন্ত বিপদজনক স্বভাব, বলতেই হবে। জীবন দিয়ে বাবা ও মেয়ে এর দায় শোধ করে গেল। একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষক, অন্যজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। শিক্ষায়তনে ওদের দরকার নেই। সহকারী প্রক্টর আর তার দলীয় পান্ডারা থাকলেই চলবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।