১৪ মার্চ ২০২৪, ১৫:৩৪

‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা বলে এমন প্রচারণা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে পারে’

নোমান বিন হারুন  © টিডিসি ফটো

রমজান বিশ্ব মুসলিমের জন্য ইবাদতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ। বছর ঘুরে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের ঝর্ণাধারা নিয়ে আসে মাহে রমজান। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের আশায় বিশ্ব মুসলিম এসময় মেতে উঠে সাহরি, তারাবি ও ইফতারের নানা আয়োজনে; খুঁজে ফেরে প্রভুর সন্তুষ্টি। এ মাস শুধু ইবাদতের জন্যই নয়। বরং সাংস্কৃতিকভাবে মুসলিমদের জন্য এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। নানা উৎসব আয়োজনে সামাজিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় করার প্রয়াস চালায় তারা। 

এই মাসে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতে মশগুল থাকার প্রচেষ্টা চালান মুসলিমরা। প্রাত্যহিক ব্যস্ততার ভার কিছুটা কমিয়ে আনতেই অফিস—আদালতের সময়সীমাও কমিয়ে আনে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মঘন্টা কমিয়ে আনার পেছনেও এই মনস্তত্ব কাজ করে। দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী সরকারি—বেসরকারি দপ্তর দিনের একটি নিধার্রিত সময় চললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হতো। তবে করোনা পরবর্তী শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে আনতে বর্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠান চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইফতার পার্টি শিক্ষার্থীদের পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। ধর্মীয় ভাবাবেগের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের এ আয়োজনে সকল ধর্ম ও মতের সবাই অংশগ্রহণ করেন। গল্প-আড্ডায় সৌহার্দ্র ও সম্প্রীতির এমন মেলবন্ধন আর কোথাও পাওয়া যায় না। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা—ইউনেস্কো বিশ্বের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইফতারকে অন্তভুর্ক্ত করেছে। 

আরো পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সমস্যা দূর করা যায় যেভাবে 

সম্প্রতি ইফতার পার্টি আয়োজনে দেশের দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অবিলম্বে এ বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মহল থেকে। ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজনের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। 

দেশজুড়ে আলোচনা—সমালোচনার মুখে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অবশ্য বলেছেন, যে আদেশের কপিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ওটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর, বিভাগ, ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, প্রশাসন ইফতার মাহফিল বাবদ কোনো বরাদ্দ দেবে না। তবে শিক্ষার্থীদের আয়োজন করতে কোন বাধা নেই। এক্ষেত্রেও সমালোচকরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় আচার অনু্ষ্ঠানে কেন বরাদ্দ থাকবে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রমজানে ইফতার এক ভিন্ন আমেজের সৃষ্টি করে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন ফোরাম ও সংগঠনও ইফতার মাহফিল করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরেই এটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান এক রেওয়াজ। তবে রোজা শুরুর মাত্র একদিন আগে শাবিপ্রবি প্রশাসনের এ আদেশ শিক্ষার্থীদের মর্মমূলে আঘাত করেছে। 

তবে ইফতার নিষিদ্ধের এ ঘোষণা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। সৌদি আরবও পবিত্র রমজান মাসে মসজিদের মধ্যে ইফতার নিষিদ্ধ করেছে। সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ইফতারি পণ্য নিয়ে মসজিদে যাওয়া যাবে না। মসজিদের পরিচ্ছন্নতার কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রোজাদারদের জন্য ইফতারি কেনার জন্য ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা যেন কোনো অর্থ সংগ্রহ না করেন— এমন নির্দেশনাও দিয়েছে দেশটির ইসলামবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

ইফতার পার্টি শিক্ষার্থীদের আনন্দ আয়োজনের এক অন্যতম অনুষঙ্গ হলেও দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সব অঙ্গসংগঠনের ইফতারে আয়োজনে অংশ নিতে গিয়ে নিজেদের ইতিবাচক শক্তি ক্ষয় করে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি এসব আয়োজনে অর্থ সংগ্রহ করাও একটি বড় বিষয়। রমজানের সিয়াম পালন করে এসব আয়োজন অনেকটাই পরিশ্রমসাধ্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ আয়োজনে শিক্ষকরাও রীতিমত হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পান না। শিক্ষার্থীদের অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আয়োজনে তাদের অংশ নিতে হয়। আর দ্রব্যমূল্যের এ বাজারে এসব আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতা বলাই বাহুল্য। 

কাজেই ইফতার নিষিদ্ধের এ ঘোষণা শুধুমাত্র এ ধারণা থেকে উৎসারিত এমনটা ভাবা ভুল হবে। এর সাথে বাঙালির সংগঠন ভাবনার বিষয়টি ভীষণভাবে যু্ক্ত। বাঙালি মাত্রেই নিজেকে কোন না কোন সংগঠনের বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে। আর সংখ্যাগুরু—সংখ্যালঘুর ব্যাপারটি নিয়ে ভাবলে বোঝা উচিত যে সংখ্যালঘূদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্বেও মধ্যে পড়ে। এটাকে ঠিক এই জায়গা থেকে তুলনা করা উচিত হবে না। করোনা পরবতী সময়ে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিফলন হিসেবে উৎসব আয়োজন কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষ থেকেও ইফতার পার্টির না করে সে অর্থ অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

রমজানে ইফতার পার্টি নিষিদ্ধ করার পেছনে রয়েছে আমাদের নিজেদের অতিমাত্রায় ‘ইতিবাচক’ প্রমাণ করতে চাওয়ার ইচ্ছা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না নিষিদ্ধ করাও একই ধারণা থেকে এসেছে। ভিন্নধর্মী মানুষদের কাছে নিজেকে ‘উদার’ ও ‘ইতিবাচক’ প্রমাণ করতে গিয়ে অগ্রিম এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অথচ ভালো করে খুঁজলে দেখা যাবে, সেখানে গরুর মাংস নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে এমন শিক্ষার্থীও সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। এটিও ঠিক একই ধারণা থেকে উৎসারিত বলে মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান সময়ে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রচারণার জন্য এসব সিদ্ধান্ত ঠিক বুমেরাং হয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে পারে; নষ্ট করতে পারে আমাদের দীর্ঘদিনের চলে আসা সম্প্রীতির পরিবেশ। সংস্কৃতিকে তার নিজ গতিধারায় চলতে  দেয়া উচিত। বিধিনিষেধ সেখানে কাম্য নয়।