৭ই মার্চের প্রত্যয় ‘মুক্তির’
বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ও বাঙালির ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা নির্ধারণের ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক ৭ই মার্চেও ভাষণ। বসন্তের এমন দিনে ৫৩ বছর পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হলেও মূল তাৎপর্য নিহিত আছে এই ভাষণের সময়ের প্রেক্ষিতে। দীর্ঘ ২৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাজনৈতিক সরকারের নিকটে ক্ষমতা অর্পণের দ্বারপ্রান্তে ছিল পাকিস্তান।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পরে অল্প কিছুদিন ব্রিটিশ আমলের নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা শাসিত হলেও পরবর্তীতে কখনই পাকিস্তানের শাসন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়নি। পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ভূমিধস ব্যবধানে জয়যুক্ত করলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক এলিট গোষ্ঠী। তারা পাকিস্তানের শুরুতে যেমন বাঙালিদের নতুন প্রভু হয়ে বসার মানসিকতা নিয়ে পূর্ব বাংলাকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করেছেন তেমনই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের পরে জনসাধারণের ভোটের রায়কে পালটে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমনই এক প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে ঘোষণা দিতে হয় “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বঙ্গবন্ধু প্রথমেই মুক্তির কথা কেন বললেন? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে। তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙালি জাতির সর্বাগ্রে দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি জাতির স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে অর্জন করা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যে লুকায়িত থাকে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। এটি অর্জন কোনো যুদ্ধ জয়ের ব্যাপার নয়। মুক্তির লক্ষ্য অনেক প্রসারিত। স্বাধীনতা বা স্বাধিকার একটি স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা। এটি অর্জিত হয়ে গেলে লক্ষ্য শেষ হয়ে যায়। এর ফলে হয়ত ক্ষমতার তখতে ভিন্ন ব্যক্তি বসবেন বা নিজ জাতির কেহ বসবেন কিন্তু মুক্তি অর্জিত হবে তখনই যখন ধনী গরিবের মধ্যে ব্যবধান থাকবে না, সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন, আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভ করবেন, গরীব বা সুবিধাবঞ্চিতরাও পরিশ্রম করে স¤পদ অর্জন করতে পারবেন, মেধা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন হবে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য শুধু ভূখণ্ড অর্জন ছিল না, মুক্তি অর্জন ছিল মূল লক্ষ্য। মুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বাধিকার মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে তবে এটি একমাত্র লক্ষ্য নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ বাংলা আন্দোলনেও সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই তিনি মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেছেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে কারাগারে থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা নতুন দল গঠনে তাঁর পরামর্শ নিয়েছিলেন এবং নতুন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থন করেছেন তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে স¤প্রদায়ভিত্তিক ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভ‚মিকা রাখতে পারে বলে। মূলত তাঁর লক্ষ্য ছিল বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা যাতে বাঙালি নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। এমনকি ভাষা আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ আছে। ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক মোড়কে না ঢাকতে বঙ্গবন্ধুর মত জাতীয় নেতারা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন না। নয়তো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চরিত্রের সাথে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই ভাষা আন্দোলনকে বঙ্গবন্ধু চিত্রায়িত করেছেন মুক্তির লড়াই হিসেবে। ঢাকার এক জনসভায় তিনি বলেছেন, “১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মত বাঁচতে চাই। আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগরিক অধিকার চাই। আমরা কথা বলার অধিকার চাই, শোষণমুক্ত সমাজ চাই” (আতিউর রহমান, সিক্রেট ডকুমেন্টস সংক্ষিপ্ত ও সরল পাঠ)। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর সর্বত্র সভা সমাবেশে তাঁর বক্তব্যের মুখ্য বিষয় ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রথম রাজনৈতিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেই নির্বাচনের ইশতেহারের ২১টি দফার মধ্যে ৮টি দফা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে। জমিদারি উচ্ছেদ, পাট ব্যবসায়, কৃষি, লবণ, সেচ, শ্রমিক, শিল্প, দুর্নীতি ইত্যাদি ছিল একুশ দফার মূল আলোচ্য। ঐতিহাসিক ছয় দফায় তিনি পাকিস্তানকে স¤পূর্ণ দ্বৈত অর্থনীতিতে ভাগ করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। ছয় দফার ৩ টি দাবি সরাসরি অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে সাজানো হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে ছয় দফা মুখ্য ইশতেহারের ভ‚মিকা পালন করলেও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে পুনুরুচ্চারিত হয়েছে।
৭ই মার্চের ভাষণে আমরা দেখতে পাই যে বঙ্গবন্ধু পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে দেশের অফিস আদালত বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। সেইসাথে শুধু পূর্ব বাংলায় লেনদেনের জন্য কিছু সময়ের জন্য ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশও দেন। এমনকি শিল্প কারখানার মালিকদেরকে নির্দেশ দেন শ্রমিকদের যাতে পূর্ণ বেতন দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বাগ্রে তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নজর দেন এবং সংবিধানে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে প্রাধান্য দিলেও বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র চীন-সোভিয়েতের প্রভাবের বাইরে দেশের জন্য প্রজোয্যতা অনুসারে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন (আবুল বারাকাত, বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ)। মুক্তির এই লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধু সমবায় ভিত্তিক অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে পদক্ষেপ নেন। খাদ্যসংকট, উৎপাদনের কাঁচামাল সংকট, বৈশ্বিক রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি, মজুতদারি, দেশবিরোধী অপপ্রচার ঠেকাতে বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দলকে একটি ছাতার নিচে এনে একটি সর্বদলীয় ব্যবস্থায় চলে আসেন। এই ব্যবস্থায় ধাবিত হতেও বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুকে যথোপযুক্ত মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি। বস্তুত বঙ্গবন্ধু তাঁর সময়ের চাইতে অগ্রসর চিন্তা করতেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, আবহমান কাল ধরে বাঙালি যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেটি অর্জন করতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সময়ের চেয়ে অগ্রসর চিন্তার কারণেই বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে বাঙালি। আমরা হারিয়েছে মুক্তির সুবর্ণ সুযোগ।
আজ যখন ৭ই মার্চের ভাষণকে মূল্যায়ন করা হয় এর গুরুত্ব তখনই পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করা যায় যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লড়াইকে বুঝতে সক্ষম হই। ৭ই মার্চের ভাষণকে শুধু পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসতে না দেওয়ার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে সেটি বাঙালি জাতির যুগ-যুগান্তরের মুক্তির লড়াইয়ের প্রতি সঠিক বিচার করা হবে না। বঙ্গবন্ধুর নিকটে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের চাইতে বাঙালির মুক্তির লড়াই ছিল মুখ্য বিষয়। সেজন্য ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে উপলব্ধি করতে হবে মুক্তির লড়াইয়ের প্রত্যয় হিসেবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
ই-মেইল: sanaullah0001@bdu.ac.bd