২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:৫৫

দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সম্ভাবনার দ্বার খুলবে ই-জুডিশিয়ারি

অভি সমদ্দার   © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। বিচার বিলম্ব, সংস্কার ও স্বচ্ছতার অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন আইনি জটিলতা, একের পর এক বিচারাধীন মামলা জমতে থাকা এবং কারিগরি অদক্ষতায় জর্জরিত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার কারণে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এখন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও আমরা বিচারকাজে আজও সেই ব্রিটিশ শাসনামলের তৈরি করে যাওয়া পদ্ধতি অনুসরণ করেই চলেছি। 

যদিও দেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সকলে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে।’ তবুও বাস্তবতার নিরিখে এর চিত্রপট বেশ ভিন্ন। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন বিচারক বলেন, ‘সাধারণত উচ্চবিত্তরা কোর্টে না এসে তাদের নিজেদের মতো করে মধ্যস্থতা করে নেন। অন্যদিকে আইনি নথিপত্রের জটিলতা সহ্য করে, সময় নষ্ট করে ও বিচারের আশায় দিনের পর দিন অর্থ ব্যয় করে হাজারো বিড়ম্বনায় পড়তে হয় ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই। মোট কথা, বিচার ব্যবস্থা আদতেও সবার জন্য সমান অভিজ্ঞতার হয় না।’  

আর এ সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে সরকার "ই-জুডিশিয়ারি" প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় বিচার বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রম ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সরকার ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার (ই-জুডিশিয়ারি) আওতায় বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। 

তবে বর্তমানে করোনা মহামারির প্রভাব ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কল্যাণে আধুনিকীকরণের ছোঁয়ায় আদালতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ফলে প্রথাগত ব্যবস্থা থেকে সংস্কারের পথে হাঁটছে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এসবের মূল লক্ষ্যই হলো— সবার জন্য দ্রুত, সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। 

কিন্তু এই ‘ই-জুডিশিয়ারি’ বলতে আসলে কি বোঝায়? সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটি হলো এমন এক বিচার ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহার করে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই ব্যবস্থায়, বিচারিক নথিপত্র, রিপোর্ট, ও অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়া করা হয়। বিচারক, আইনজীবী, সাক্ষী, এবং অন্যান্য বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ডিজিটাল মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এবং বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। 

২০২০ সালে আদালত কর্তৃক 'তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন' দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, যেটি সত্যিকার অর্থেই আদালতের কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজড করার ক্ষেত্রে একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এর ফলস্বরূপ ই-জুডিশিয়ারির আইনি কাঠামো বাস্তবিক রূপ পায়। এছাড়াও ইতিমধ্যে আদালতের জন্য নিজস্ব ওয়েবপোর্টাল, ই-কার্যতালিকা, অনলাইন জামিন নিশ্চিতকরণ ম্যানুয়াল, এবং মাইকোর্ট অ্যাপের মতো উদ্যোগ নাগরিকদের কাছে তথ্য ও পরিষেবা প্রাপ্তিকে সহজলভ্য করেছে। এমনকি ডিজিটাল যুগের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য একটি সাইবার ট্রাইব্যুনালও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

এই প্রকল্পের ফলে বিচার বিভাগের কার্যক্রমে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বিচারিক ফাইলস, নথিপত্র, এবং অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল হওয়ায় সেগুলো আর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনলাইনে মামলা দায়ের, শুনানি, এবং নথিপত্র সংগ্রহের ব্যবস্থার ফলে বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত এবং সহজ হয়েছে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থান থেকে বিচার প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণের সুযোগের ফলে বিচারের সুযোগ সকলের জন্য আরও সহজ হয়েছে। 

মহামারি সময়কালীন ভার্চুয়াল আদালতের শুনানিতে হাজারের বেশি মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে মামলার জট মোকাবেলায় ই-জুডিশিয়ারি বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। এখন তো সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে মুলতবি মামলার সারাংশ দেখা যায় এবং আপডেটগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়, যা একই সাথে স্বচ্ছতা এবং সময়োপযোগিতা নিশ্চিত করে। আর পুরো কার্যধারায় কাগজের ব্যবহার সীমিতকরণের মধ্য দিয়ে পরিবেশের সুরক্ষাও নিশ্চিত হচ্ছে। 

এসব শুনতে বিস্ময়কর লাগলেও এসবের পুরোপুরি বাস্তবায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ দীর্ঘসময়ের ব্যাপার। এক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারে আদালতের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা এবং তাদের মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব আদালতে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায়। সাথে আইনি ও নৈতিক জটিলতা তো আছেই। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যেমন পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ঘাটতি এবং ধীর গতির ইন্টারনেট সংযোগ, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে আইন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান কম হওয়ায় তারা ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারছে না। 

অন্যদিকে একজন অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বলতে গেলে, অপরাধবিজ্ঞানের তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে— ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার। এতে ভুক্তভোগী স্বয়ং অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন। 

উদাহরণস্বরূপ, ভুক্তভোগী স্মার্টফোনের বদৌলতে ডিজিটাল প্রমাণ হিসেবে সাক্ষ্য-প্রমাণের বদল ও পরিমার্জিত করে অপরাধীর অপরাধের গভীরতা (Gravity of offence and its punishment) বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে করে অপরাধী সেই শাস্তিও পেতে পারে, যে কাজ সে আদৌ করে নাই। অন্যভাবে একজন অপরাধী ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে বা ভুক্তভোগীকে হুমকি দিয়ে বা ভুক্তভোগীকে ভুল তথ্য দিয়ে অপরাধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। 

এছাড়াও, যদি কোনো ভুক্তভোগীকে একটি অনলাইন ফর্মে একটি অভিযোগ দায়ের করতে হয়, তাহলে অপরাধী ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে বা ভুল তথ্য প্রবেশ করে ভুক্তভোগীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলতে পারে। 

আবার সুষ্ঠু বিচারের জন্য বিচারব্যবস্থা ও আদালতের মূলনীতির সাথে ডিজিটাল পরিবেশের সমন্বয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তথ্য সুরক্ষা এবং এর গোপনীয়তা সর্বোপরি বজায় রাখা দরকার। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো সংবেদনশীল ঘটনার ক্ষেত্রে তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে ই-জুডিশিয়ারি পদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির মতো বিদ্যমান আইনগুলির সংশোধন প্রয়োজন। 

সর্বোপরি এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে আইন ও ই-জুডিশিয়ারি সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করার জন্য প্রচারণামূলক ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। বিজ্ঞ আদালতের বিচারকমন্ডলী থেকে শুরু করে পাবলিক প্রসিকিউটরসহ সকল কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। 

প্রযুক্তি ডিভাইসসমূহের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য আদালতে একটি পৃথক আইসিটি সেল এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠার করা যেতে পারে। মাইকোর্ট অ্যাপের সাথে জমির রেকর্ড এবং পুলিশ এর ডেটাবেসসমূহ একত্রীকরণ করা যেতে পারে। যাতে কেউ তথ্য সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে না পারে। কোর্টরুমে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সুব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (ADR) মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুবিচারের ব্যবস্থা সহজেই করা যাবে। ফলে রাষ্ট্রীয় টাকা ও সময় দুটোই বেঁচে যাবে। 

এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্রত্যক্ষভাবে নাগরিকরা সরাসরি আইনি সহায়তা ভোগ করতে পারবেন। ই-সমন  প্রক্রিয়ায় সাক্ষীকে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে পরবর্তী শুনানির জন্য অবহিত করা যেতে পারে। তাইতো, ই-জুডিশিয়ারি সিস্টেমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যমান আইন আনতে আইনি কাঠামোর সংশোধন অপরিহার্য। 

পরিশেষে বলতে চাই, এক অপার সম্ভাবনাময় ও আরও কার্যকরী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যথাযথ সরকারি পদক্ষেপ নেবার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছার জোরে আমাদের স্মার্ট  বাংলাদেশে ডিজিটাল ন্যায়বিচার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। তবে ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি এর অন্যান্য সংস্কারও প্রয়োজন। যেমন— বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা কমানো, এবং বিচারের ক্ষেত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

লেখক: শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়