২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:১৬

ব্লু ইকোনমিতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা ও অগ্রগতি

আশামনি  © টিডিসি ফটো

ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রের তলদেশের বিশাল সম্পদ কাজে লাগানোর অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির বিষয়টি দিনদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের রং নীল আর সে কারণেই সমুদ্র কেন্দ্রিক পরিচালিত অর্থনীতিকে বলা হয় ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি।

পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে সমুদ্র। মৎস্য সম্পদের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ, যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের একটি দক্ষ মাধ্যমে হিসাবে তেল ও গ্যাস সম্পদ আহরণেও সমুদ্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও সমুদ্র খনিজ সম্পদ, মিথেন গ্যাস, কপার লবণ, বালি, গ্রাভেল, কোবাল্ট ইত্যাদি পাওয়া যায়। অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ১৯৯৪ সালে ব্লু ইকোনমির ধারণা দিয়ে থাকেন।

পরবর্তীতে ব্লু ইকোনমি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক  সম্মেলন হয়েছে  যার মধ্যে ২০১২ সালের রিওডিজেনেরিও ব্রাজিলে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক  জাতিসংঘ সম্মেলনিও+২০.!ব্রাজিলের রিওডিজেনেরিও +২০ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের সামুদ্রিক এলাকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সমুদ্রের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা অপরিহার্য।

জাতিসংঘ ২০১৫ এর মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সুনীল অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই লক্ষ্যে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ  টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণ করেছে যার মূল লক্ষ্য সুনীল অর্থনীতি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা -১৪এ বলা হয়েছে টেকসই উন্নয়ন সমুদ্র অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য।

বর্তমান বিশ্বে সুনীল অর্থনীতি অবদান রেখে চলেছে। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য সংগঠিত হয়।বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৪৩০কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি যথা, সামুদ্রিক মাছ,উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর প্রায় ৩০ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রের বিশাল গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বর্তমানে আমদানি ও রপ্তানির জন্য সমুদ্রপথ এক নির্ভরযোগ্য অবস্থান। আমদানি ও রপ্তানি প্রায় ৬০ভাগ আসে সমুদ্রপথে। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০% সমুদ্র পরিবহনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।

বৈশ্বিক গ্লোবাল পর্যটন শিল্প এবং প্রকৃতি নির্ভর পর্যটন শিল্পের বিকাশে সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমুদ্র আমাদের ৭২% এবং বায়োস্ফিয়ারে  পৃথিবীর প্রায় ৯৫% অক্সিজেন সরবরাহ করা, কার্বনডাইঅক্সাইড ত্যাগ করা,পুষ্টি সরবরাহ করা, পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে  জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করা নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমুদ্র আমাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে রেখেছে। বিশ্বে মোট হাইড্রোকার্বনের ৩২% সরবরাহ হয় সামুদ্রিক উৎস থেকে।তাই ক্রমশ ই ব্লু ইকোনমি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কারণ সিংহভাগ মানুষই সমুদ্রের সুবিধার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।

জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের মতে ২০৫০সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হয়ে ৯০০কোটি এ বিশাল জনসংখ্যা চাহিদা মিটাতে আমাদের সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর এই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমুদ্র সম্পদ বিশাল অবদান রাখছে।গবেষকরা মতামত দিয়েছেন যে এ বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার চাহিদা মিটানোর জন্য সমুদ্র সম্পদের বিকল্প নেই। সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্রনির্ভর ঔষধশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।

বিগত বছরগুলোতে যতগুলো আন্তর্জাতিক  সম্মেলনে হয়েছে সবগুলো সম্মেলনে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।২০১২সালের রিও +২০,সমুদ্র বিষয়ক এশীয় সম্মেলনে ২০১৩ সালের বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু গ্রোথ ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। UNEP, OECD, WB (বিশ্ব ব্যাংক) EU (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মূলে রয়েছে ব্লু ইকোনমি। ইন্দোনেশিয়ার `The lombok Blue Economy Implementation Programme'এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৭৫,০০০ লোকের কর্মসংস্থান সহ প্রতি বছর ১১৫কোটি মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। জাপান, থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্লু ইকোনমি অবদান রাখে।

বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা আয় করে নিচ্ছে।বাংলাদেশের জন্যও সমুদ্র বিশাল অর্থনৈতিক অবদান রাখে।বঙ্গোপসাগরে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে সমুদ্রের বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪সালে সমুদ্র বিজয় অভিযাত্রার সূচনা করেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্র সম্পদের সীমা  নির্ধারণ, সমুদ্র সম্পদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, সমুদ্র সম্পদ সংগ্রহ ও আহরণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম 'দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট প্রণয়ন করেন।পরবর্তী সময়ে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ১৯৭৪ সালের আইএটি প্রয়োজনীয় সংশোধন পূর্বক 'টেরিরোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইমজোনস (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২১ প্রনয়ন করেন।

ওই বিলে 'ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন দ্যা ল অবদ্যসি (আনক্লোস -১৯৮২) ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক  আইন এবং সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলা রায়ের যথাযথ প্রতিফলন ঘটানো হয়। ২০১২ ও ২০১৪সালে ভারত ও মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা জয়ের সাফল্য লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়।

সমুদ্র বিশ্লেষকরা মতামত দিয়েছেন জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বজায় রেখে সমুদ্রে সম্পদের টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নত জীবিকা কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার উন্মোচিত করেছে। সমুদ্র নির্ভর ব্লু ইকোনমির যথাসাধ্য ব্যবহার করতে জানলে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে এবং সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষা করা যাবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।

ব্লু ইকোনমির অগ্রযাত্রা আমাদের তারুণ্য সমাজের জন্য একটা আশীর্বাদ। তারুণ্য সমাজের জীবিকা নির্ভরে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশের জন্য যা একটি বড় পাওয়া। ব্লু ইকোনমি উন্নয়নে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জসমূহ হলো-পর্যাপ্ত নীতিমালার ও সঠিক কর্ম পরিকল্পনার অভাব,দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব,সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্যে অভাব, মেরিন রিসোর্স গবেষণা না হওয়া, ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাব এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ না থাকা। নির্ভরযোগ্য তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান করে বিনিয়োগকারীদের এই খাতে কীভাবে আকৃষ্ট করা যায় এবং এই খাতে কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে যাতে আরও বেশি উন্নতি সম্ভব হয়। বাংলাদেশর সমুদ্র সীমানায় যে সকল অনাবিষ্কৃত সম্পদ আছে সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশ বান্ধব সংগ্রহ এবং টেকসই বাজার নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের জাল, জেলে, ট্রলার এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে যে জ্বালানি সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় সেটায় ব্লু ইকোনমি ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রের নিচে ২২০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৪৭ প্রজাতির মাছ,৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ০৬ প্রজাতির কাঁকড়াসহ সমুদ্রের তলদেশে মিথেন গ্যাস জমাট বাধার ধারণা পাওয়া গেছে যা উন্নয়তল বাংলাদেশের ওশানোগ্রাফি কাজ করে চলছে। ধারণা করা হচ্ছে দেশের সমুদ্র অঞ্চলে যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে তা একশ বছর বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামুদ্রিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম। সেজন্য ব্লু ইকোনমির যথাসাধ্য ব্যবহার নিশ্চিত করে সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারলে বাংলাদেশ অতিশীঘ্রই আরও উন্নয়নশীল হয়ে উঠতে পারবে।