বই পড়ে প্রশ্ন করতে না শিখলে ভারবাহী জীবে পরিণত হয়
বই পড়া খুবই ভালো অভ্যাস। তবে ফেসবুকে বই নিয়া শো অফ করা ভালো না। কথাটা শুনে বিদগ্ধ পাঠকরা মাইন্ড কবরেন না। কথাটা আপনাদের উদ্দেশ্য বলতেছি না। উঠতি বয়সী বিশেষ করে ভার্সিটির উঠান পাড়ানো বহু পোলাপান বই জিনিসটারে চায়ের কাপ, রেশমি চুড়ি কিংবা গোলাপের মত এস্থেটিক জিনিস মনে করেন। মনে করাটা দোষের কিছু না, যদি আসল উদ্দেশ্য ব্যহত না হয়।
প্রশ্ন হলো, বই পড়ার কাজ কি? নিছক মজা পাওয়া? তাহলে বই পড়া আর টিকটকের শর্টস দেখার মধ্যে তফাৎ কি রইল? বই নিশ্চয়ই গ্রেটার কোনো পার্পাস সার্ভ করে। বই কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই প্রশ্নগুলো নিয়া মাথা খাটাইতে খাটাইতে আমাদের মস্তিষ্ক শানিত হয়। এভাবে একটা ভাল গল্প কিংবা ভাল ননফিকশন আমাদের চিন্তার খোরাক দেয়।
একজন ভালো পাঠক হওয়ার জন্য স্কেপটিক্যাল মাইন্ড লাগে। অর্থাৎ আপনি যা পড়তেছেন সেইটাকে বারবার প্রশ্ন করতে হবে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়া বই পড়লে এই স্কেপটিক্যাল হওয়া যায় না। আপনি যদি মনে করেন, রিডিং পড়ার মত করে প্রকান্ড ইটের মত একখানা বই পড়লে আপনি বিদ্যার জাহাজ হবেন, আপনার এই বুঝ সহী না। মনোযোগ না দিলে বই পড়া খুব বেশি কাজে দেয় না। মনোযোগ আনার জন্য স্কেপটিক্যাল হওয়াটা জরুরি।
বইয়ে যা লেখা আছে, তার সব সত্যি এই মাইন্ডসেট নিয়ে বই পড়লে একটা সময় চাইলেও মনোযোগ ধরে রাখা যায় না। মোদ্দাকথা, একটা ভাল বই পাঠককে যত প্রশ্নের উত্তর দেয় এর চেয়ে তার মনে অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দেয়।
একটা উদাহরণ দিই। ভার্সিটি গোয়িং বহু ছেলেমেয়ে পুলিৎজার জয়ী লেখক জ্যারেড ডায়মন্ডের "গানস জার্মস এবং স্টিলস' বইটা নাড়াচাড়া করেছে। বইটার স্টোরিং টেলিং দুর্দান্ত। তবে মজার ব্যাপার হল, বইটা নিয়ে এক ধরনের ফেটিস দেখেছি অনেকের মধ্যে। একই ধরনের ফেটিস আছে হারারির সেপিয়েন্স বইটাকে নিয়েও।
আমি বই দুইটার ক্রিটিক লিখতে বসি নাই। প্রসঙ্গের খাতিরে বই দুইটার নাম নিলাম বই পড়ার সময় ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর অভাব কীভাবে ক্ষতি করে সেইটা বোঝানোর জন্য।
কলাম্বাসের আগমনের আগে সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং সাউথ আমেরিকায় অ্যাজটেক এবং ইনকা নামের দুইটা বড় বড় সভ্যতা ছিল, যদিও অ্যাজটেকরা নিজেদের অ্যাজটেক বলতো না। তবু আলোচনার সুবিধার্থে আমরা অ্যাজটেকই বলি। জেরেড ডায়মন্ড আর্গু করেছেন, স্প্যানিয়ার্ডরা নিউওয়ার্ল্ড অর্থাৎ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় আসার সময় গুটি বসন্তের ভাইরাস নিয়ে এসেছিল।
যুদ্ধবিগ্রহে যে পরিমাণ অ্যাজটেক ও ইনকা মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে শতগুণ বেশি মানুষ নাকি সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। স্প্যানিস কনকোয়েস্টের পর নিউ ওয়ার্ল্ডের জনসংখ্যা সিগনিফিক্যান্টলি ড্রপ করার পেছনে ডায়মন্ড এবং অন্য অনেক গবেষক ভাইরাসকে প্রধানত দায়ী করেছেন। কিন্তু বিষয়টা কি এতই সহজ?
সেই উত্তর জানার জন্য আমাদের ইতিহাস কীভাবে লেখা হয় সেটা বুঝতে হবে। যেহেতু অতীতে সিসিটিভি ক্যামেরা ফিট করা ছিল না, তাই সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল তা জানা সম্ভব না। তবে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এবং আর্কেওলজিক্যাল এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে আসল ঘটনাটাকে রিকন্সট্রাকশন করা হয় বা বানানো হয়।
এই রিকন্সট্রাকশন নৈর্ব্যক্তিক নয়। ফলে একই ইতিহাসের বিভিন্ন রকম পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কোন একটা ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করার সময় ব্যাখ্যাটা কতটুকু কনভিন্সিং সেটা দেখার পাশাপাশি, বর্ণনাকারী কাদের পক্ষের লোক সেইটাও দেখা জরুরি।
এবার "গানস জার্মস এবং স্টিলস" বইটায় ফিরে আসি। আপনি যদি কোনো প্রকার প্রশ্ন করা ছাড়া বইটা পড়ে মুগ্ধ হন, আপনার মনে হবে মেসো-আমেরিকা এবং সাউথ আমেরিকার সভ্যতাগুলোর পতনের পেছনে ইউরোপীয়দের কোনো ভূমিকাই নাই। গুটিবসন্তে কোটি কোটি মানুষ এমনি এমনি মরে সাফ হয়ে গেছে। আমি বলছি না, গুটি বসন্তে প্রি-কলম্বিয়ান সিভিলাইজেশনের প্রচুর মানুষ মারা যায় নাই। কিন্তু জার্ম আসলে সভ্যতাগুলোর পতনে কতটুকু ভূমিকা পালন করেছে?
জার্ম থেকে যে এত মানুষ মারা যায় নাই, এটার পক্ষেও একাডেমিক আলোচনা আছে, পেপারও আছে। যেখানে আর্গু করা হয়েছে মেসো আমেরিকানদের ঘোড়া বা অন্যকোনো যানবাহন ছিল না। তার উপর অসুস্থদের পক্ষে বেশিদূর হাঁটাও সম্ভব না। তাহলে ভাইরাস এত তাড়াতাড়ি ছড়াইল কীভাবে? জেরেড ডায়মন্ডের বই পড়ে আপনার মাথায় যদি ওই আলোচনাগুলো শোনার আগ্রহ না আসে তাহলে বুঝতে হবে আপনি ফ্যানবয়, পাঠক না।
জেরেড ডায়মন্ডের "গানস জার্মস এন্ড স্টিল"কে অনেকে আদর করে অ্যাকাডেমিক পর্ন বলেন এবং সেইটা বলার যথেষ্ট শক্ত কারণই আছে। আমি একবার হারারির হোমো সেপিয়েন্সকে চানাচুর মার্কা বই বলছিলাম- খেতে ভালো লাগে। বেশি খেলে পেট খারাপ হয়।
কোনো এক তালেবর এসে আমার সাথে মহাতর্ক জুড়ে দিল, সেপিয়েন্স নাকি অ্যাকাডেমিক বই! তার যুক্তি হইল সে তার এক পেপারের ইন্ট্রোডাকশনে সেপিয়েন্স থেকে কোট করেছে। মজার ব্যাপার হইল লাইনটা একদম ট্রিভিয়াল, কমন সেন্সিকাল। যেইটার জন্য আলাদা করে কোনো কিছু সাইট করার দরকারই নাই। যাই হোক নির্বোধের সাথে তর্ক করতে নাই।
প্রশ্ন করতে শেখা জরুরি। বই পড়ে যারা প্রশ্ন করতে শেখে না দিনশেষে তারা ভারবাহী জীবে পরিণত হয়। ভার হিসাবে বই নিতান্তই মূল্যহীন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা