শিক্ষা রূপান্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ
প্রশিক্ষণ সেশনে শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। ভাষা ও যোগাযোগ (Language and Communication) বিষয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে জানতে পারি ছাত্রজীবনে তাদের ইংরেজি শেখার অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যাশার কথাগুলো। ইংরেজিতে প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন না হওয়ার কারণ হিসেবে ছাত্রজীবনের কিছু গল্প ঘুরে ফিরে আসে। যেমন-
-ইংরেজির ভালো শিক্ষক পাননি
-ইংরেজি নিয়ে ভীতি, লজ্জা, সংকোচ কাজ করেছে
-প্রাইভেট পড়ার টাকা ছিল না
-ইংরেজি শিখেছেন শুধু পরীক্ষায় পাস নম্বর পাওয়ার জন্য।
- ইংরেজির দক্ষতা আজকের দিনে এত প্রয়োজনীয় একটা দক্ষতা (Skill) হিসেবে কাজ করবে- এই কথাটা শিক্ষকরা আগে থেকে বলেননি।
অর্থাৎ উনাদের পড়াশোনা কখন, কীভাবে, কতটা বাস্তব জীবনে উনারা কাজে লাগাতে পারবেন অথবা কখন এটি সময়োপযোগিতা হারাবে- এ বিষয়টা নিয়ে তাদেরকে ছেলেবেলা থেকেই কেউ সেভাবে প্রস্তুত করেননি। এখানে ইংরেজিতে দক্ষতা বলতে প্রশিক্ষণার্থীরা মূলত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ইংরেজিতে কম্যুনিকেশন- এর জন্য প্রয়োজনীয় স্কিল বা দক্ষতাকে বুঝিয়েছেন।
আমি এক পর্যায়ে উনাদেরকে নতুন কারিকুলামের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের প্রথম অধ্যায় Talking to People এর পেইজ খুলে দেখালাম। এই অধ্যায়ে ৫টি different situation এ ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কীভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে তা দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য, এখানে ELT এর শিক্ষার্থীরা EAP, ESP এর পার্থক্য ও Inductive, Deductive method এর প্রয়োজনীয়তা, উপস্থিতি, অনুপস্থিতি রিলেইট করতে পারবেন।
এরপর আমরা রোল প্লে করলাম। আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষক। উনারা ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের আনন্দ সত্যিই আমাকে দারুণ আশাবাদী করেছে। এটি কিন্তু ৬ষ্ঠ শ্রেণির একটি মাত্র অধ্যায়। ৬ষ্ঠ শ্রেণি শেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীরা একে একে ৭ম, ৮ম , ৯ম, ১০ম, ১১শ, ১২শ শ্রেণির পড়া শেষ করবে। ততদিনে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে দারুণ দক্ষতা (reading, writing, speaking, listening) চলে আসবে তা সত্যি অনুমেয়।
প্রশিক্ষণার্থীরা (শিক্ষক, প্রধানশিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষা কর্মকর্তা) আমাকে বললেন, এভাবে যদি শ্রেণি শিক্ষকরা পড়াতে পারেন তাহলে তো এটা একটা দারুণ কিছু হতে যাচ্ছে। সত্যিই তাই। বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে যদি নিয়মিত লেখেন বা স্কুলের পেইজগুলো আরেকটু বুস্ট আপ করেন, তাহলে অনেকের মনের মধ্যে থাকা ধোঁয়াশা কেটে যাবে। কারণ, দিন শেষে কারিকুলাম বাস্তবায়নের কাজটি সফল হবে আমাদের শ্রেণিশিক্ষকদের মাধ্যমে।
প্রশিক্ষণে আমাদের শিক্ষকদের প্রশ্ন করা শিখতে হবে। আমাদের পরম্পরাগত (Traditional) শিখন/শেখানো পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন তা ভিন্ন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের মাধ্যমে সকল শিক্ষকের জন্য একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রশিক্ষণের সময় প্রশ্ন করবেন। না বুঝলে বার বার জানতে চাইবেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো যখন পাবেন, তখনই আপনারা সঠিকভাবে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।
অনেকেই বলেন, শিক্ষকদের দক্ষতা না বাড়ালে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন কঠিন। আসলে অনেকসময় শুধু দক্ষতাই যথেষ্ট নয়। একজন শিক্ষক নিজে যা বিশ্বাস করেন, তার উপর শিক্ষার্থীদের অনুভবের জাগরণ ঘটে। একজন শিক্ষক ১৪ ডিসেম্বরের শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে তার চিন্তায়, মননে কতটুকু ধারণ করছেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করছেন, যে দায়িত্ববোধ, আবেগ, প্রত্যয় নিয়ে দিবসের তাৎপর্য শিক্ষার্থীদের অনুধাবন করার কথা সেটি সঠিকভাবে হচ্ছে নাকি শিক্ষকের উপস্থাপন কৌশলের জন্য বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে, জাতীয় দিবসগুলো তার গুরুত্ব, গাম্ভীর্য হারাচ্ছে- সেটিও দেখতে হবে।
শিক্ষকতা পেশা আর আগের জায়গায় থাকবে না। বর্তমান কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য যত চ্যালেঞ্জ আসবে সেগুলো মোকাবেলা করে তবেই শিক্ষকতা পেশায় টিকে থাকতে হবে। শিক্ষায় আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা ৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরে হয়ে গেছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারছি না বলেই আজও আমরা এত কষ্ট করছি। নিজেরা ভালো শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করছি। হিমশিম খাচ্ছি। নতুন কারিকুলামে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করবে অনেক। ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ওদেরকে দিয়েই ওদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সহযোগিতা করতে হবে। আর সেই প্রস্তুতি নিয়েই ক্লাসে যেতে হবে। রাগ করা যাবে না, বিরক্ত হওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিভাবকদের উদ্বেগ কমাতে নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে। তাই বলছিলাম শিক্ষকতা আর আগের রূপে থাকবে না।
সারা দেশে নতুন কারিকুলামে ৮ম এবং ৯ম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩। আমাদের শিক্ষকরা কারিকুলামের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন, পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে কোন প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে যাচ্ছেন, পাশাপাশি তারা নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষণ নেবেন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য। সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষকদের ব্যস্ততা থাকবে অনেক।
যারা কথায় কথায় আমাদের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিশেষণে অসম্মান করেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রল করছেন, তারা জানবেন আমাদের এই দেশ কিন্তু বদলে যাবে আমাদের শিক্ষকের হাত ধরেই। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন অনেক প্রশ্ন করবে। বর্তমান কারিকুলামে ওরা ক্লাসে বাজেট তৈরি শিখছে হাতে কলমে। ফলে একজন নিম্ন আয়ের পেশাজীবীর বাজেট যেমন তার সন্তান করবে, একই সাথে সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারের সন্তানও তা করতে শিখছে। ওরা কিন্তু ওদের পরিবারেও প্রশ্ন করবে। ওরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করবে। চোখ তুলে সন্তানের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন তেমন অভিভাবক হতেও যোগ্যতা লাগবে।
বর্তমান কারিকুলামে আমাদের শিক্ষার্থীরা হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক। তারা হবে সৃজনশীল। তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে যে কোনো পরিবেশে। ওরা হবে সুখী, ওরা হবে বিশ্বনাগরিক। এই কারিকুলাম শুধু শিক্ষায় নয়, পুরো সমাজের রূপান্তর ঘটাবে। যে সমাজ, যে রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের জাতির পিতা, তার সত্যিকারের রূপান্তর ঘটাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এবং সেই রূপান্তর ঘটবে শিক্ষকদের হাত ধরেই।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ সফল হোক। সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি ও উপপরিচালক, প্রশিক্ষণ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর,বাংলাদেশ, ঢাকা।