নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। হাজার বছরের বাঙালির রুদ্ধ ইতিহাসের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বাঙালি। তিনি ছিলেন মানবতার তূর্যবাদক এক সেনানীর নাম। ছিলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংহত রুপ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নজরুল সাহিত্যের বিশিষ্ট লক্ষ্মণ। বাংলার নবজাগরণে যেসব লেখকদের লিখা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ ভাবে অবধান রাখে তাদের মাঝে অন্যতম হলেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম’। আজও নজরুলের সাম্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা কে বুকে লালন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে বাঙালি জাতি।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ,কবিতা,উপন্যাস, গল্প, নাটক সহ প্রায় সর্বত্রই তাঁর পদচারণা ছিলো। শিক্ষা থেকে খেটে-মজুর পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর সাহিত্য। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো পন্ডিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় উচ্চতর শিক্ষিত এবং জ্ঞানে কালজয়ী মেধার অধিকারী এক বিরল ব্যক্তিত্ব।তিনি তাঁর আত্মোপলব্ধি এবং মানবতাবাদী চেতনার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়েছেন। সমকালীন হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, মনোমালিন্য দেখে তিনি অসাম্প্রদায়িক হন। তিনিই প্রথম সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা করেন। পা থেকে নক পর্যন্ত হয়ে উঠেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ত্ব। নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ত্ব বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। সত্য,সুন্দর, কল্যাণের পূজারী নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানব মুক্তি। তাই তিনি সচেতনভাবে সম্প্রদায় নিরপেক্ষ সম্প্রতি প্রত্যাশা করেছেন।
কাজী নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখার মাধ্যমে যে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তার মাঝে অন্যতম হলো 'রুদ্রমঙ্গল' গ্রন্থ। যেখানে সোচ্চারী বলিষ্ঠ কন্ঠের বাণী বিবৃত হয়েছে। এসব লিখায় তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি। তিনি বিদ্রোহ করেছেন, ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর লেখনীতেই। নজরুল এমন এক রৌদ্র তেজের কামনা করতেন, যা সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজ তলে নিয়ে আসবে। কারণ মানুষেরা আজ মানুষের অকল্যাণে লেগে আছে। যে অবতাররা মানুষের জন্য ধর্ম মাতালদের হাতে মার খেয়েছেন। তাদের শিষ্যদের করুণ অবস্থা দেখে নজরুল ব্যথিত হয়েছেন। সমাজের মানুষের দু:খ না বুঝে মসজিদ, মন্দির নিয়ে পড়ে আছে। তারা ভাবে মসজিদ-মন্দিরে ইবাদত, প্রার্থনা করলেই স্রষ্টা খুশি হবেন। তাতেই সফলতা। কিন্তু আদতে মোটেও তা নয়। এজন্যই নজরুল 'মন্দির ও মসজিদ' প্রবন্ধে বলেন "ভূতে-পাওয়ার মতো ইহাদের মন্দিরে পাইয়াছে, ইহাদেরে মসজিদে পাইয়াছে। ইহাদের বহু দুঃখ ভোগ করিতে হইবে!"
এই যে মানুষের মন্দির-মসজিদ নিয়ে এতো মাতামাতি আর একে অপরের পাশে না দাড়ানো (ধর্মীয় বিভাজনের কারণে), তা নজরুল ঘৃণা করতেন। তিনি চাইতেন, কে বিপদে পড়লো তা বড়ো না। তাঁর বিপদটা আসল। এক মানুষ আরেক মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবে, তাই কাম্য। তাইতো কবি অন্যত্র কবিতার ভাষায় বলেছিলেন..
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
(কান্ডারী হুশিয়ার)
বহু লিখায় নজরুল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরেছেন। এ কথা বলা বাহুল্য যে, নজরুল লিখার মধ্যেই কেবল তা আবদ্ধ রাখতেন না। বরং ব্যক্তিজীবনেও তা অনুকরণ ও অনুসরণ করতেন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, হিন্দু পরিবারের মেয়ে প্রমীলা দেবীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ। এসকল কারণেই বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ নজরুলকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাঁর এক প্রবন্ধের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘নবযুগের’ ঈদসংখ্যায় (১৯৪৫) লিখেছেন, “এক বাঙালির ঘরে আনন্দময়ীর গান এবং আরেক বাঙালির আকাশে ঈদের চাঁদ—এই দুয়ে মিলিয়ে বাঙালি জাতি। এই বৃহত্তর বাঙালি জাতির কবি নজরুল। রবীন্দ্রনাথের আনন্দময়ীর আগমনের গানের পাশে তাই নজরুলের গান—‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।”
অসাম্প্রদায়িক লিখার কারণে তৎকালীন মানুষেরা নজরুল কে কাফের বলতো,নাস্তিক উপাধী দিতো।কিন্তু নজরুল এসব পাত্তা দিতেন না, গায়ে মাখতেন না।এ প্রসঙ্গে নজরুল বলেন,
‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনওটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
একজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতার কারণে নজরুলকে নানান সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। সে পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলতে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লিখা 'জাতীয় কবি এবং তাঁর জ্যোতির্ময় পুরুষ'- নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া একটি গল্প বয়ান করছি। নজরুল রক্ষণশীল মওলানা আকরম খাঁ এবং তাঁর পত্রিকা মোহাম্মদী নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করলেও মওলানা সাহেবের স্ত্রীর কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। নজরুলের লেখা গান শুনতে তিনি ভালোবাসতেন। নজরুলকে নিয়ে তখন অবিভক্ত বাংলায় নিন্দার ঝড় বইছে। তিনি তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!’ এই লাইনটি লিখে তখনকার রক্ষণশীল হিন্দু এবং মুসলমান দুই সমাজেই নিন্দিত হচ্ছেন। রক্ষণশীল হিন্দুরা তাঁকে বলছে, নাস্তিক ম্লেচ্ছ এবং রক্ষণশীল মুসলমানরা তাঁকে গালি দিচ্ছে কাফের বলে।
এই সময় মওলানা আকরম খাঁর পত্নী একদিন কলকাতার সব জাঁদরেল মওলানাকে তাঁর কলকাতার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। বাড়ির বসার ঘরে একটা উঁচু মঞ্চের মতো তৈরি করে তা পর্দার আড়াল দিয়ে রাখা হলো। মওলানা সাহেবরা তাঁদের আসন গ্রহণ করলে পর্দার আড়াল থেকে দরাজ গলায় গজল ভেসে এলো—‘ইসলামেরই সওদা লয়ে এলো কে ওই সওদাগর।’ পরেই আরেকটি গজল, ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে, যেন পূর্ণিমারই চাঁদ দোলে।’ গায়ক দরদি কণ্ঠে গাইলেন, ‘ফোরাতের পানিতে নেমে কাঁদে মাতা ফাতেমায়।’
গজল শেষ হলো। আমন্ত্রিত মওলানা সাহেবরা তখন ভাবাবেগে আপ্লুত। আকরম খাঁ সাহেবের পত্নী তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই গজল যিনি গাইলেন, তিনিই এগুলো লিখেছেন, তাঁর সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কী? মওলানা সাহেবরা তখন ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এই কবির জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসের দরজা খোলা। তাঁর কোনো হিসাব-কিতাবের দরকার হবে না।’ মঞ্চের পর্দার আড়াল থেকে যুবা গায়ক বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মওলানা সাহেবদের চক্ষু চড়কগাছে। এ যে তাঁদের কথিত কাফের কবি নজরুল। তাঁদের মুখে তখন আর কথা নেই।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতিক
নজরুল আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু না থেকেও তিনি আছেন,কর্মের মাধ্যমে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে।নজরুলের মতো আমরাও বিভেদ মুক্ত এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ কামনা করি।নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতার আলোকে সুর মিলিয়ে বলতে চাই.. "আমি শুনিতেছি মসজিদের আজান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি। তাহা এক সাথে উত্থিত হইতেছে ঊর্ধ্বে– স্রষ্টার সিংহাসনের পানে। আমি দেখিতেছি, সারা আকাশ যেন খুশি হইয়া উঠিতেছে"।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।