শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের একক ভর্তি পরীক্ষার প্রত্যাশা এখনও প্রবল
এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার মোট ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছে দশ লক্ষাধিক। গতবছরে পছন্দ মতো ভর্তি হতে পারেনি যারা এবছর আবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে চায় এমন সংখ্যা রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। ফলে উচ্চশিক্ষায় মেডিকেল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যত্র বাদ দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু সংখ্যা দশ লাখের মতো।
এখন সঙ্গতভাবেই উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, অপেক্ষা করছে। এ সাথে তাদের অভিভাবকদের উদ্বেগও বাড়ছে। পছন্দমত বা কোথাও ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত এ উদ্বেগের অবসান নেই। এবার বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে একক পরীক্ষার উদ্যোগের কথা গতবছর থেকে চাউর হয়। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একক ভর্তি পরীক্ষার কথা ঘোষণা দিয়ে কমিটি বা কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ সম্পর্কে গত ৬-৭মাসে বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হওয়ায় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আশায় বুক বেঁধে আছেন, অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। তবে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি খবরে উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে। বলা হচ্ছে, আগের মতো ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে এবং অন্যগুলো গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। সবশেষ ইউজিসি চেয়ারম্যান আশাহত হওয়ার সেই খবর দিয়েছেন। তার বক্তব্যের পর আশাহত না হয়ে পারা যায় না। বার বার মনে হয় -এমনটি হতেই পারে না।
ভর্তি পরীক্ষার এ যুদ্ধে আর্থিক ব্যয়, যাতায়াতের ভোগান্তি, হয়রানি ও মানসিক পীড়ন থেকে রক্ষায় একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দাবি গত কয়েক বছর ধরে জোরালো হয়ে ওঠে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ তাঁর সময়কালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে এবং অন্য অনেক স্থানে বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভোগান্তি অবসানে উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে তিনি বার বার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তার প্রতি শতভাগ সমর্থন দেন অভিভাবক ও সচেতন মহল। তাঁর সময়কালে শেষ কয়েক বছর ২০-২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ, ৮টি কৃষি বিশ্বদ্যিালয় ও ৪টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ফলে কিছুটা ভোগান্তি কমলেও তা পূর্ণভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণ করেনি। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের যুক্তি চাপ ও প্রত্যাশা এখনও প্রবল। একক ভর্তি পরীক্ষার পথে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ ও অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার ফলে এ বিষয়ে ভর্তিচ্ছু ও তাদের অভিভাবকরা অত্যন্ত আশাবাদী ছিলো।
আরও পড়ুন: দেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাবে শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাসের স্বীকৃতি?
অভিভাবক হিসেবে অনেকেরই বিগত বছরের সীমাহীন অনেক কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা মনে আছে। মেয়ে বা ছেলেকে সাথে নিয়ে মফস্বল থেকে ঢাকায় যানজটে পড়ে অনেক বয়স্ক অভিভাবক, অনেক শ্বাসকষ্টের মানুষের দমবন্ধের উপক্রম হয়েছে। পথে ৬-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারেনি, তখন এই অবস্থা চেপে রেখে কিডনির ওপর চাপ বাড়িয়েছেন। ট্রেনের টিকিট পেতে পরীক্ষার্থীদের ১২-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বই-খাতা সাথে নিয়ে রেলস্টেশনের কাউন্টারে অসহ্য গরমে দিন-রাত কাটাতে হয়েছে। এখন অনলাইনে টিকিট পাওয়া গেলেও ট্রেনের ও আসন সংখ্যার তুলনায় ১০-১৫গুণ পরীক্ষার্থী। টিকিট পেতে গলদঘর্ম হতে হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পনের থেকে বিশ হাজার টাকার গড় ব্যয় অনেকে বহন করতে না পেরে ধার-দেনা করে পথে নেমেছেন-এমন অসংখ্য ঘটনা শোনা গেছে অভিভাবকদের কাছ থেকে। আবার অভিভাবকহীন, অথবা অসুস্থ অভিভাবক সাথে আসতে না পারায় ছেলে বা মেয়েটিকে দূর-দূরান্তের পথে একা পাঠিয়ে হাউ মাউ করে কেঁদেছেন, পথের দিকে চেয়ে ছিলেন বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত।
আর কতোটা বিশ্ববিদ্যালয়েই বা দৌঁড়ানো সম্ভব? অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বুয়েটে একদিন, দুইদিন ধরে একই ইউনিটের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত একই ইউনিটের পরীক্ষা কয়েক ব্যাচে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিষয় এক, ইউনিট এক অথচ প্রশ্ন ভিন্ন রকম। কিন্তু পাশেই ছিলো রুয়েট, মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ এসব প্রতিষ্ঠানে একসাথে আসন ব্যবস্থা করে একই প্রশ্নে কি একই সময়ে পরীক্ষা নেওয়া যেতো না? একাধিকবার ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে একই ইউনিটের পরীক্ষা নিয়ে প্রকৃতভাবে ন্যায়ত মেধা যাচাই কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে? পরীক্ষার্থীরা অনেকে বলেছেন সকালে বা তার আগের ব্যাচের যে প্রশ্ন হয়েছে, তাতে তার কমন প্রশ্ন ছিলো বেশি।
এর এক ধাপ বাড়িয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ইউনিটের জন্য ৬ বার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, প্রশ্ন ৬ রকম। এতে পরীক্ষার্থীরা এক সাথে এক প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে পারেনি, তাদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি- এ নিয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নানা মন্তব্য করেছেন। এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে যেয়ে, মন্তব্য করে অনেকেই বলেছেন, করোনাত্তোর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা, কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাতের কথা হয়তোবা এসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় ছিলো কি না, মাথায় এসেছে কি না তা সন্দেহ।
একক ভর্তি পরীক্ষার পথে কতোটা প্রস্তুতি বা অগ্রগতি হয়েছে এটা জানার চেয়ে বরং এবার এ ব্যাপারে একটা কিছু হবে-এমন ধারনা ছিলো ভর্তিচ্ছু ও অভিভাবকদের বদ্ধমূল। এর কারণ, গত কয়েক বছর গুচ্ছ বা সমন্বিত কিংবা বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনে প্রায় শতভাগ সাফল্য আশার সঞ্চার করেছে। বলা যায়-এসব ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে দেশে একটা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা আগের বছরের চেয়ে এবার আরও ভালোভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইসিটি বা অনলাইন প্রক্রিয়ার সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা যুক্ত করলে, পর্যালোচনার মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ যে সম্ভব এটা পর্যবেক্ষকমহল মনে করে। হয়তো এবার একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে কিছুটা সমস্যা আসতে পারে, শতভাগ অর্জন নাও হতে পারে। কিন্তু উদ্যোগ বাস্তবায়নে গেলেই তো তা সমাধান সম্ভব হবে।
বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের একক ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ ও সচেতন মহলের প্রত্যাশা পূরণে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি প্রত্যাশিত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেখান থেকে পিছিয়ে আসার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি এ ব্যাপারে ব্যর্থ হওয়ারও অবকাশ নেই। এমন একটি চ্যালেঞ্জ থেকে সাফল্য অর্জন করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি নিরসনতো জাতীয় দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও উচ্চশিক্ষায় জনপ্রত্যাশা পূরণ তথা উদ্ভুত কোনো সমস্যার সমাধান দেওয়াও এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য।
গবেষণা বা নতুন নতুন উদ্ভাবনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দেশ, জনগণ, বৈশ্বিক চাহিদা পূরণ করবে, দিক-নির্দেশনা দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই তো প্রত্যাশিত। মনে রাখা দরকার ‘পথে না বেরোলে পথের সন্ধান মেলে না।’ তাই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যতো চ্যালেঞ্জ আসুক, সমস্যা বা জটিলতার উদ্ভব হোক বিশ্বাস করা যায় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দক্ষতা রয়েছে তা দিয়েই তা মোকাবেলা করা সম্ভব। আশা করা যায়, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিলে, এগিয়ে আসলে ঐতিহাসিক এ অর্জন সম্ভব। অন্তত দেশের সাধারণ মানুষের দিকে তাকিয়ে,তাদের ভোগান্তি লাঘবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসির পদক্ষেপে সাফল্য আসবেই। তথ্য-প্রযুক্তিতে দেশের গত একযুগের অর্জন ও সাফল্যের দিকে তাকিয়ে। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
লেখক: পরিচালক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।