১৭ অক্টোবর ২০২৩, ২০:১৭

ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নারীর প্রতিবন্ধকতা

রিয়া রানী মোদক  © টিডিসি ফটো

সাংবাদিকতায় পুরুষের তুলনায় নারীকে অনেক বেশি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। প্রথমত তাকে প্রমাণ করতে হয় পুরুষ যে কাজটা করতে পারে সেটা তারাও করতে সক্ষম। তারপর তাকে পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। কেউ কেউ মনে করেন নারী সাংবাদিক মানেই হলো তারা হালকা বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করবেন।

একজন নারী সাংবাদিককে একজন পুরুষের তুলনায় বেশি ও ভিন্নমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পুরুষ সমাজের একটা বড় অংশই মনে করেন সাংবাদিকতা নারীর পেশা হতে পারে না। সাংবাদিকতা পড়তে এলেও পরিবার থেকে নারীদেরকে একরকম যুদ্ধ জয় করবার মতো জিতে আসতে হয়।

মতিঝিলের সমাবেশে একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনসহ আরও কয়েক নারী সাংবাদিকের ওপরে করা হামলার কথা আমরা জানি। এ হামলার কারণ কী? 

ফরিদা ইয়াসমিন, রোজিনা ইসলাম, আঙ্গুর নাহার মন্টি, মুন্নী সাহাদের মতো নারী সাংবাদিকদের আমরা দেখে আসছি। নেত্রকোনার মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিক আলপনা বেগমের নাম আমরা জানি। যারা সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় শুধু ভালোই করেন নাই, সাংবাদিকদের বিভিন্ন ফোরাম ও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে যাচ্ছেন।

এরপরেও দেখা যায় বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠানে নারীদেরকে শুধু সাংস্কৃতিক, জীবনচারণ কিংবা সাহিত্য-ফিচার পাতার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, অপরাধ বা কিংবা আরও সব গুরুত্বপূর্ণ বিটে না দিয়ে। এত এতবার নারী সাংবাদিকরা তাদের যোগ্যতার পরিচয় দেওয়ার পরও তাদেরকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কিন্তু তাদের লড়াকু মন তাদের দমিয়ে রাখতে পারে নাই।

সাংবাদিকতার আঁতুরঘর বলা হয় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতাকে। নারীদের অগ্রযাত্রা বেশিরভাগ সেক্টরে অনেকটা পরিলক্ষিত হলেও ক্যাম্পাস সাংবদিকতায় খুব একটা চোখে পড়ে না। 

ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নারীরা ভালো-মন্দ দুই ধরনের অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন হয়। কিছু সত্য ও যৌক্তিক খবর তুলে ধরার কারণে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয় দায়িত্বশীল মহলের। আবার কিছুক্ষেত্রে প্রশংসাও পায়। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নারীদের চ্যালেঞ্জের কথাই আসে শুরুতে। কেননা, ক্যাম্পাসে সন্ধ্যার পর থাকা যায় না অধিকাংশ সময়ই। এ ছাড়া যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে একজন নারীর সেখানে অবস্থান বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

একজন নারী সাংবাদিককে একজন পুরুষের তুলনায় বেশি ও ভিন্নমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পুরুষ সমাজের একটা বড় অংশই মনে করেন সাংবাদিকতা নারীর পেশা হতে পারে না।

পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধবাদী আচরণ, গ্রুপিংয়ের উত্তাপ, রোষানল, পক্ষ-বিপক্ষ, ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব, প্রশাসনের জবাবদিহিতা, সংবাদ প্রকাশের জেরে শত্রুতা, নানাবিধ কঠিন পরিস্থিতি তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে যতগুলো সাংবাদিক সংগঠন আছে হিসাব করলে তার সমপরিমাণ নারী সাংবাদিক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর যে কমিটি ঘোষণা করতে দেখা যায় সেখানে নারীদের নাম চোখেই পড়ে না। আশ্চর্যের বিষয়, স্বনামধন্য, দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রথম স্থান অর্জন করে যেখানে ভর্তি হচ্ছেন, যেখানে কৃতী নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি সেখানের সাংবাদিক সংগঠনে নেই কোনো নারীর অংশগ্রহণ।

আর সেখানে নারীর নেতৃত্ব তো ঢের বাকি। আশার বিষয় হলো হাতে গোনা কিছু নারী যারা এসেছেন তারা তাদের নামের পাশে ঠিকই সুনাম, সম্মান ও অবস্থানের তারকা বসাতে পেরেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সাংবাদিক সমিতি সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সংগঠনটি এক্ষেত্রে অন্যতম বলা যায়। কেননা, বেসরকারি পর্যায়ে এখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে মুন্নি আক্তার নামে প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক।

এ ছাড়া, গোপালগঞ্জের ভিসি হটানো সেই জিনিয়ার কথা বলতে পারি। যার নেতৃত্বে পরবর্তীতে চলেছিল বশেমুরবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি। 

তবে প্রাপ্তিও কম না। সাংবাদিকতার সুবাদে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হয়ে কথা বলতে ও লিখতে পারছে ক্যাম্পাসে কিংবা হলে কিছু শিক্ষার্থীর ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে নারীরা। ধীরে ধীরে তারা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় আগ্রহী হচ্ছেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজেকে দক্ষ করে তুলছে। ভবিষ্যত কর্মজীবনে এই অভিজ্ঞতা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে। নারীরা এগিয়ে আসলে নারী সাংবাদিক বলারই কোনো প্রয়োজন হবে না। সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত হবে সবাই।

গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির নারী সাংবাদিক সানজিদা আক্তার পিংকি মনে করেন, নারীদের জন্য সাংবাদিকতা বিষয়টাই অনেকের কাছে ঠিক স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো। হোক সেটা পেশাগত জীবন কিংবা ক্যাম্পাস। লোকমুখে শুনতে হবে সমালোচনা। পরিবার প্রতিদিন না হোক, নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন মনে করাবেই, এ পেশায় উন্নতি নেই বরং ঝুঁকি প্রচুর।

তার মতে, বাস্তব জীবনে ফিরে যখন ওই নারীমাত্রই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে বাধ্য এমন সান্ত্বনা দিয়ে নিজেকে শক্ত করতে শুরু করবেন, পাশ থেকে বন্ধুটি বলে উঠবে- কিরে সাংঘাতিক! এই পথচলায় অনেককেই শিকার হতে হয় বিভিন্ন হয়রানি, হুমকি, মামলা কিংবা সাইবার বুলিংয়ের। এ ছাড়াও পরিবারের বাঁধা তো আছেই। দিনশেষে এত শত চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করলেও কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া না। পদোন্নতি না ঘটা বা সংবাদ মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

ইসলামী বিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষক তন্ময় সাহা জয় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা দেখা যায়। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নারী সাংবাদিকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ছাত্রী সংখ্যা থাকলেও সাংবাদিকতায় কেন তাদের এই অনাগ্রহ? নাকি পরিবেশটাই এমন হয়ে গেছে, সেটা জানতে হবে।