‘কাফকা অনুভূতি’: চারপাশের ঘটনাবলীকে অসঙ্গতিপূর্ণ, উদ্ভট, অযৌক্তিক, অতিপ্রাকৃত মনে করার অনুভূতি

অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ  © সংগৃহীত

আজকাল পত্রিকার খবরে মন ভালো করার মত তেমন কিছু পাই না। তাই মাঝে মাঝে ব্যাপারগুলোকে লঘু ভাবে দেখার জন্য উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসে। যেমন দেখলাম এক তথাকথিত গায়েবি মামলায় মৃত মানুষের নাম নাকি আসামির তালিকায় আছে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য তো এটি একটি নিদারুণ অন্যায় আচরণ বটেই, কিন্তু ভাবছি পুলিশ যদি আসলেই মামলাটি গ্রাহ্য করে আসামিকে রিমান্ড-এ আনার চেষ্টা করে, তাহলে? দারুণ ভৌতিক গল্পের প্লট মাথায় আসছে, অ্যামেরিকার স্যাংশন-এর চেয়েও মারাত্মক পরিণতি!

পত্রিকার অন্য এক খবরে দেখলাম এক মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী কর্মী কয়েক বছর ধরে দেশে আসতে পারছেন না কারণ তিনি ইতিমধ্যে পুলিশের করা রাজনৈতিক সহিংসতার একটি মামলার আসামি, যদিও ঐ  সহিংসতার ঘটনার সময় তিনি তাঁর বিদেশের কর্মস্থলে ছিলেন। তাঁর এক আত্মীয় সরকার-বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, কিন্তু এ কারণেই তাঁকে আসামি করা হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে চেষ্টা করেও নাকি কোন সদুত্তর পাচ্ছেন না।

বিখ্যাত জার্মানভাষী সাহিত্যিক ফ্রান্‌ৎস কাফকা-এর অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস "দ্য ট্রায়াল"-এর গল্পের সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। গল্পের প্রধান চরিত্র দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টাতেও সে বিচারককে খুঁজে পাচ্ছেন না এবং অনেক অফিস-আদালতে ঘোরাঘুরি করেও কী অপরাধের জন্য তাঁর বিচার হয়েছে তা জানতে পারছেন না।

প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির নানা ঘটনা প্রতিনিয়ত সংবাদে আসে। অথছ, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা আমার প্রাক্তন ছাত্রদের অনেককেই জানি তারা ব্যক্তিগত ভাবে সৎ এবং দেশের জন্য ভালো কাজ করতে চায়, কিন্তু পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল অবস্থার চাপে তারা প্রায়শই নিজেকে নিরুপায় মনে করে। এ প্রসঙ্গে কাফকা-এর আর একটি বিখ্যাত বই "দ্য মেটামরফোসিস"-এর গল্প মনে আসে। আমার সম্প্রতি প্রকাশিত "মার্কেটস, মরালস এন্ড ডেভেলপমেণ্ট" (রুটলেজ, ২০২২, পৃষ্ঠা ৬১) বইয়ে শাসনব্যবস্থার নিয়ম-নীতির প্রসঙ্গে কাফকা-এর এই গল্পটির উল্লেখ আছে।

"দ্য মেটামরফোসিস"-এর গল্পের প্রধান চরিত্র একজন দোকান কর্মচারি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল সে একটি বৃহদাকারের তেলাপোকায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে থাকা বা অনেক কষ্টে উঠে ঘরের ভেতর ঘুরাফেরা করা ছাড়া আর কিছু সে করতে পারে না। পরিচিত মানুষদের অনেক অসঙ্গত আচরণ, অন্যায় অবিচার সে প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু প্রতিবাদ বা প্রতিকার করার ক্ষমতা তার নাই।

চারপাশের ঘটনাবলীর কথা মনে করলে একটা "কাফকা অনুভূতি" (kafkaesque feeling), অর্থাৎ এসবকিছুকে অসঙ্গতিপূর্ণ, উদ্ভট, অযৌক্তিক, অতিপ্রাকৃত মনে করার অনুভূতি হতেই পারে।

[লেখক: বিশিষ্টি অর্থনীতিবিদ]


সর্বশেষ সংবাদ