যৌবনের ঈদগুলোতে শৈশবের সেই আমেজ নেই
শৈশবের ঈদ বহুমুখী আমেজ নিয়ে আসত। দূরন্ত শৈশবে আমার কাছে ঈদ মানে ছিল মূলত মায়ের হাতে তৈরি নানানরকম পিঠার স্বাদ। আমার বেড়ে উঠা নিতান্তই একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানে গ্রামের মা-চাচীরা পাথরের পাটায় বা ঢেকিতে চালের গুড়া করে পিঠা-পুলি বানাতেন। ঈদের আগের দিন হতে ঈদের দিন ভোর পর্যন্ত চলত এই যজ্ঞ। আমরা ছোটরা ছোটাছুটি করতাম, খবরদারি করতাম, কাজের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করতাম।
মাঝে মধ্যে দুষ্টামি করে ঢেকি পাড় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেজন্য অবশ্য বকাও খেতে হতো। আমার পছন্দের একটা পিঠা ছিল ‘তেলের পিঠা’ যেটা ‘মালপুয়া’ নামেও পরিচিত। আমার মনে আছে—আমি এই পিঠা বানানোর শুরু থেকেই খেতে থাকতাম। নেহায়াতই গলা পর্যন্ত না হলে খাওয়া শেষ হতো না।
ঈদের নতুন জামা ছিল পিঠার পরেই অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যাপার। পরিবারের সদস্যদের নিজের নতুন জামা দেখাতাম। আশেপাশের সমবয়সীদের দেখাতাম। ঈদে নতুন জামা না পেলে মন খারাপ হতো। তবে পিঠার স্বাদের কাছে সেটা ক্ষনেই হার মেনে যেত।
ঈদের দিন পরিবারের সদস্যদের থেকে সেলামি পেতাম। বিশেষত, মায়ের হাঁস-মুরগি বেঁচা, ডিম বেঁচা টাকা থেকে বড় মাপের অপ্রকাশিত সেলামি। বড় দুই ভাই চাকরি করত, উনারাও ছিল সেলামির বড় বড় সোর্স।
ইদুল আজহাতে কোরবানির পশু ছিল ঈদের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। সারাবছর গরু-ছাগলের ধারে কাছেও যেতাম না। কোন দিন গৃহপালিত পশুদের একবেলা খাবার দিতাম না। অথচ, কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে বড় মাপের কামলাগিরি দেখাতাম। একদিনের জন্য বড়মাপের কসাই হতাম।
শৈশবে একটু বেশিই দুষ্ট ছিলাম। ঈদের নামাজ না পড়ে ওই সময়ে সেলামির টাকায় কেনা মার্বেল দিয়ে বাজি খেলতাম। এলাকার বন্ধুবান্ধব, ছোট বড় বিভিন্ন বয়সের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ফটকা (অনেকটা আতশবাজির মতোন) ফুটাতাম। দলবেদে আশেপাশের বিভিন্ন ঈদগাহ মাঠ পর্যবেক্ষণ করতাম। ঈদগাহ মাঠের পাশেই মেলার মতো ভ্রাম্যমাণ দোকান বসত।
সেখানে নানা রকমের সদাই (খাবার) পাওয়া যেত। আর এখানেই সালামির অধিকাংশ টাকা খরচ হতো। ঈদে আমরা কয়েকজন মিলে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম। অবশ্য হলে সিনেমা দেখাটা ওই বয়সে দুঃসাহসিক ও ঝুকিপূর্ণ ছিল। সাথে বড় দুই এক জন থাকলে তবেই যেতাম। হলে না গেলে বাজারে সিড়ি আর ভিসিআরে টিকিট কেটে অবশ্যই সিনেমা দেখা হতো।
ঈদের কয়েকদিন বাজারে বিকেল বেলায় মিনি সিনেমা হলগুলোতে আক্ষরিক অর্থেই ঈদের আমেজে গমগম করত। সেই সময়গুলোতে সিনেমা দেখতে গিয়ে ক্যারেক্টারের মধে ঢুকে যেতাম। বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় ছোট ছোট যত গাছ থাকত তাদের সাথে নায়কচিত রূপে মোকাবিলা হতো। কলাগাছ, কচুগাছসহ অন্যান্য গুল্ম জাতীয় একটা গাছও রেহাই পেত না। ডান্ডা মেরে সবাইকে ঠান্ডা করে দিতাম।
ঈদ উপলক্ষে বিটিভিতে কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা হতো। এগুলোর মধ্যে রাতে হওয়া নাটকগুলো ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে নাটক দেখতে দেখতে ঘুমাতে যেতাম।
বর্তমান সময়ে অর্থাৎ যৌবনের এই ঈদগুলোতে নেই সেই আমেজ। আমেজ নেই বললে ভুল হবে। আমেজ আছে; তবে তাদের জন্য, যারা আছে সেই শৈশবে। তবে এখনকার শৈশব ওইসময়ের শৈশব থেকে ভিন্ন। তাদের ঈদ উৎযাপন আর ঈদের আমেজ ভিন্ন। আমি বিষণভাবে অনুভব করি সেই দিনগুলোর অনুপস্থিতি।
এখন ঈদের দিন শুরু হয় মমতাময়ী মা, বটবৃক্ষ ও ভরসার আশ্রয়স্থল বাবার কবরে জমা আগাছা পরিষ্কার করে। আহা, কত স্বার্থপর আমরা। কীভাবে আমরা মা-বাবাকে ভুলে থাকি। যে মা নিজের ঈদ আনন্দ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের হাসিমুখে জন্য সারারাত যাপন করে পিঠা বানাতো। নিজে না খেয়ে আমাদের পূর্ণ তৃপ্তির জন্য যেকোন বিষয়ে সেক্রিফাইজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না।
সেই গর্ভধারিণী, জন্মদাতা মাতাকে ভুলে দিব্বি ভাল আছি। আমি জানি আমাদের ভাল থাকার জন্যই উনি সেক্রিফাইজ করতেন। আমরা যথেষ্ট ভাল আছি মা। আমরা যথেষ্ট ভাল আছি বাবা। সৃষ্টিকর্তা তোমাদেরকেও ভাল রাখছেন, সেই বিশ্বাস আমাদের আছে। জান্নাতে ভাল থেকো তোমরা। দোয়া রেখো যেন সব সময় ভাল থাকতে পারি, ভাল কাজের সাথে থাকতে পারি।
এখন সকালে নামাজে যাওয়ার আগে ভাবীদের তৈরী মিষ্টান্ন খাবারে মিষ্টিমূখ করি। নেই শৈশবের রুচি। নেই সেই আমেজ। সাধ্যমত ভাতিজা, ভাতিজী, চাচাত ভাই বোনদের সালামি দিয়ে থাকি। এখন চাচাত ভাই-বোন, ভাতিজা, ভাতিজীদের আনন্দে সেই দিনগুলো স্মৃতিচারণ করে থাকি। নামাজ শেষে মা-বাবার করব জিয়ারত করি।
ঈদে বিষণভাবে মিস করি মা-বাবাকে। ঈদুল আজহাতে কোরবানি মাংস কাটা, সমাজ আর আত্মীয়স্বজনের মাঝে বিতরণ করি। সবার ছোট হওয়ায় মাংস বিতরণের দায়িত্ব বরাবর আমার উপরই ন্যাস্ত। শৈশব নেই, নেই নতুন জামা, পিঠাপুলি আর সিনেমা নিয়ে কোন আকর্ষণ। ঈদে বিকালবেলা কাটে পুরোতন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে।
শৈশবের ঈদ আনন্দ না থাকলেও ঈদ উৎযাপনের চেষ্টা করে থাকি। আহা, যদি আজীবন শৈশবেই থাকা যেত কতই না মজা করা যেত। জানি এ সম্ভব না। শৈশব আর ফিরে আসবে না। চিরন্তন সত্য হচ্ছে—পরিবর্তন আর বৈচিত্র্যেই জীবন। পরিবর্তনকে মেনে নিতেই হয়, মেনে নিয়েছি।
ঈদ-উল-আজহা আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। সঞ্চারিত করে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা। এ মর্ম অনুধাবন করে সমাজে শান্তি ও কল্যাণের পথ রচনা করতে আমাদের সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হতে হবে। পবিত্র ঈদ-উল-আজহার আনন্দ ও ত্যাগের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন। এই দিনে মানুষে মানুষে প্রীতি ও বন্ধনের যোগসূত্র আরও সুদৃঢ় হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোবিপ্রবি