ইসরাইলে বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন কার স্বার্থে?

মেহেদী হাসান
মেহেদী হাসান  © ফাইল ছবি

‘একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচনী ব্যবস্থা অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে’। ২০১২ সালে নিজের দেয়া একটি ভাষণে এভাবেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সমর্থন করেছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু সময় বদলেছে, পরিস্থিতি বদলেছে, বদলে গেছেন নেতানিয়াহুও। এবার তার সরকারই এমন কিছু উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করছে, যা ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্টকে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করবে। 

মূলত দ্বন্দ্বের শুরু ৯০ এর দশক থেকে, যা গত তিন দশক ধরে ইসরাইলের রাজনীতিতে বিরাজমান। ১৯৯২ সালের আইনে ইসরাইলী সুপ্রিম কোর্টকে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এরপরে অন্তত ২০ বার সুপ্রিম কোর্ট এই ক্ষমতার ব্যবহার করে যার মধ্যে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী সেটেলমেন্ট আটকে দেয়া এবং উগ্র ডানপন্থীদের জন্য সরকারের দেয়া কিছু বাড়তি সুবিধা বাতিল করার মত সিদ্ধান্তও রয়েছে। 

এবার নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতায় লাগাম টানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যা ইসরাইলী জনগণকে দু-ভাগে বিভক্ত করেছে। ইসরাইলি ডেমোক্রেটিক ইনডেক্স (আইডিআই) এর সাম্প্রতিক সময়ের  জরিপ অনুসারে ৫৩% ইসরাইলী জনগণ সুপ্রিম কোর্টকে ক্ষমতা দেয়ার পক্ষে মত জানিয়েছে। ইসরাইলে বসবাসরত আরব জনগণের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতার পক্ষে মত দিয়েছেন শতকরা ৮৭ ভাগ জনগণ। জরিপে পক্ষে মত দেয়া জনগণের বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে বাম অথবা মধ্যপন্থার অনুসারী। জরিপ হতে এটি স্পষ্ট যে সরকারের হাতে এই মুহুর্তে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার মত পর্যাপ্ত জনসমর্থন নেই, কিন্তু তবুও নেসেটে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠের জেরে ইসরাইলী সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে, যা চলমান সংঘাতকে উস্কে দিচ্ছে।

নেতানিয়াহু পূর্বেও ক্ষমতায় ছিলেন। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার তিনি যাদেরকে নিয়ে জোট করেছেন এদের বেশিরভাগই উগ্র ডানপন্থী, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং গোঁড়া ইহুদীবাদের সমর্থক। এরা যে-কোনো মূল্যে পশ্চিম তীর এবং ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে ইহুদী বসতি স্থাপন করতে চায়। নেতানিয়াহুর সরকার ও ক্ষমতায় এসে এই কাজে নিজেদের অগ্রাধিকারের কথা জানায়।

নেতানিয়াহু সরকারের এবারের পরিকল্পনায় রয়েছে ইসরাইলের হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো, এবং যেসব বিষয়কে কোর্ট ইতঃপূর্বে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে, নেসেটের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সেগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনা। এরমধ্যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব বসতি স্থাপনকে কোর্ট বাতিল করেছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত করার মত সিদ্ধান্তও রয়েছে। বিচারকদের নিয়োগে সরকারের ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করার মত পরিকল্পনাও রয়েছে। এই বিষয়ে ইসরাইলী সরকারের যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু বিচারপতিরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন, সেহেতু অধিকতর গণতন্ত্রের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতেই এসব ক্ষমতা থাকা উচিত, যদিও বিরোধীরা সরকারের এসব যুক্তিকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে আসছে।
 
ইসরাইলী সরকারের এ প্রচেষ্টা ইসরাইলের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুত্ববাদী মতবাদের সমর্থকদের সাথে ধর্মীয় এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের সমর্থকদের দ্বন্দ্বকে আরো প্রকট করে তুলেছে। যার ফলাফল ইসরাইলে চলমান সংঘাত, সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা, প্রভাবশালী আমেরিকান ইহুদীদের সমালোচনা এবং দীর্ঘসময়ের জন্য অস্থিরতার ইংগিত।

ডানপন্থী দলগুলো চাচ্ছে ইসরাইলকে এমন একটি গণতন্ত্রের রূপ দিতে, যেটি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র এবং পার্লামেন্ট হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। অন্যদিকে বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলো চাচ্ছে একটি উদারনৈতিক গণতন্ত্র যেখানে সব পক্ষেরই সহ-অবস্থান থাকবে এবং কোর্টের হাতে ক্ষমতা থাকবে পার্লামেন্টের আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার, যা ভারসাম্য তৈরি করবে আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে। ইসরাইলী কোর্টকে ইসরাইলের সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ, বিশেষত আরব ফিলিস্তিনীদের জন্য কিছুটা হলেও সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলী সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিম তীরে ব্যক্তিমালাকাধীন ইহুদি আবাসন স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছিলো, যদিও কোর্ট নিজেই ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের আদেশ দেয়ার মতো উদাহরণও রয়েছ। 

এই বিষয়ে ডানপন্থীরা যাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেন, মি. বারাক (৮৬); যিনি কিনা ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চিফ জাস্টিস ছিলেন। এই সময়ে তিনি এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন যা কোর্টকে অনেক বেশি সক্রিয় করে সরকারের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে। বিচারমন্ত্রী মি. লেভিন তাকে একটি দুর্যোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যে ইসরাইলের গণতন্ত্রকে নষ্ট করেছে বলে মনে করেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজতে থাকা ধর্মীয় এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলো, কোর্টের ক্ষমতা কমানোর জন্য বর্তমান সময়কেই উপযুক্ত বলে মনে করছে। এই বিষয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টি।  তারা এটিকেই বড় সুযোগ বলে মনে করছে, যা পশ্চিম তীরসহ  অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে বসতিস্থাপনের অবাধ সুযোগ করে দিবে। শোনা যাচ্ছে লিকুদ পার্টির পক্ষ থেকে ডানপন্থী দলগুলোকে পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করার মতো প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। নব্বই এর দশকে ফিলিস্তিনের সাথে  একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি করতে না পারার ব্যর্থতা এই দলগুলো বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোর প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং ২১ টি ইসরাইলী বসতি ভেঙ্গে দেয়া এই দলগুলোকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে।

বিচার বিভাগের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে উগ্র ইহুদীদেরও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকার বিভিন্ন সময়ে এই পক্ষগুলোকে সরকার ইসরাইলের বিভিন্ন অংশে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, নিজেদের মত করে শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো, এবং বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আসছিলো। কোর্ট মাঝেমাঝে এইসব সুবিধাকে কমিয়ে এনেছে। ২০১২ সালে কোর্ট গোঁড়া ইহুদীদের সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতির সুবিধাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়। যদিও এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয় নি, তবুও এই দলগুলো মনে করে, হাইকোর্ট তাদের অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল না। মি. পালেই, জেরুজালেম ভিত্তিক একটি রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যান, মনে করেন এই দলগুলো এখন আর কোর্টকে বিশ্বাস করে না। কোর্ট বারবার তাদের জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ করেছে বলেই মনে করেন তিনি।

নেতানিয়াহু, যার দল কিনা একসময়ে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বড় সমর্থক ছিলো, নিজেদের অবস্থান বদল করে এখন ডানপন্থীদের সাথে সুর মেলাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কোর্টে চলমান দুর্নীতির মামলার বিচারগুলোকে মনে করছে। ধারণা করা হচ্ছে তিনি এমন কোনো আইন পাশ করতে চাচ্ছেন, যা তার বিরুদ্ধে চলমান মামলায় বিচার করার পথ বন্ধ করে দিবে, যদিও নেতানিয়াহুর সরকার বরাবরই এই ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এই মামলাগুলোর রায় হলে নেতানিয়াহুর রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ারও আশংকা করা হচ্ছে।।

দুর্নীতির অভিযোগের পরও নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা তাকে উদারপন্থী দলগুলোর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এবং ধর্মীয় ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইহুদিবাদী দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহুর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে বিচারব্যবস্থার পরিবর্তনের নিজেদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে।  মি. মেরিডর, সাবেক বিচারমন্ত্রী ও লিকুদ পার্টির নেতা, যিনি কিনা ৯০ এর দশকে ছিলেন বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার একজন জোরালো সমর্থক ছিলেন মনে করেন  লিকুদ পার্টি এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ইসরাইলি বিচার বিভাগ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে, তা ইসরাইলের রাজনীতিতে সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। ডানপন্থীদের এই উত্থান মধ্যপ্রাচ্যকে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের জনগণকে আরো বিপদের মুখে ঠেলে দিবে। ক্ষমতায় থাকার জন্য লিকুদ পার্টিকে এই দলগুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, যা পশ্চিম তীরসহ অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে আরো ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের মত সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বাধ্য করবে। ইসরাইলের রাজপথে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণের অবস্থান সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে কতটা সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দিবে। যদিও এখনো সরকার বা সহযোগী দলগুলো থেকে পিছিয়ে আসার কোনো ইংগিত মেলেনি। চলমান অচলাবস্থায় সবচেয়ে বেশি শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ ফিলিস্তিনীরা, যাদের সাথে রয়েছে এই সিদ্ধান্তের সরাসরি সংযোগ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Source:
1. ://www.nytimes.com/2023/03/10/world/middleeast/israel-judicial-reform-netanyahu.html
2. https://www.google.com/amp/s/www.timesofisrael.com/israelis-deeply-split-on-courts-and-rights-but-united-in-gloom-distrust-poll/amp/
3. https://www.bbc.com/bengali/articles/cl5109qx1e3o


সর্বশেষ সংবাদ