বই পড়ে কী হয়?
বই পড়লে জ্ঞান হয়, আনন্দ হয়—এইগুলা তো জানা কথা। শুধু জ্ঞান আর আনন্দ মোটিভ হিসেবে যথেষ্ট না, জাগতিক কিছু কারণ থাকা লাগে। আজকে সেই জাগতিক কারণগুলো বলি। এগুলো আমার নিজের সরাসরি অভিজ্ঞতা, কাজেই আত্মপ্রচারের মত শোনাতে পারে (আল্লাহ মাফ করুন)। তবুও বলছি, কারণ আমি মনে করি এই জিনিসগুলো জানলে যারা বই পড়বেন কীনা ভাবছেন, তারা দ্বিধা ছেড়ে পড়া শুরু করে দেবেন। চলুন শুরু করা যাক!
বই পড়ায় আমার জাগতিক (materialistic) লাভ কী কী হয়েছে?
১) ছোটবেলা থেকে বিচিত্র সব বিষয়ে শত শত বই পড়ার ফলে বিসিএস এর সিলেবাস ৮০% আগে থেকে জানা ছিলো। আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি ২৩ বছর বয়েসে, সার্ভিসে ঢুকেছি ২৫ বছরে। আমার জেনারেশনে আমি সবচাইতে কম বয়েসে সার্ভিসে যারা ঢুকেছে তাদের একজন আলহামদুলিল্লাহ, এবং বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমানে সর্বকনিষ্ঠ এসপি। বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে এটা হত না।
২) বই পড়ার কারণে যে কোনো মানুষের সাথে আলাপচারিতার একটা বিশাল সুযোগ হয়েছে। আমার দুটো ফরেন মাস্টার্স দুটোতে সুযোগ পাওয়া স্রেফ এই কারণে। টোকিওটেকে মাস্টার্সের কারণ প্রফেসর এম আমার সাথে কথা বলে মনে করেছেন আমি ওখানে মাস্টার্স করার সম্ভাবনা রাখি, স্রেফ এই কারণে উনি আমাকে রেকমেন্ড করেছিলেন।
আর হার্ভার্ডে এপ্লাই করার কারণ নাভিদ মাহবুব ভাইসহ আরো পাঁচ ছয় জনের একটা গ্রুপ (এরা সবাই টপ স্কুল গ্র্যাজুয়েট) আমাকে সাহস দিয়েছিলেন যে আমি ওসব জায়গায় এপ্লাই করার যোগ্যতা রাখি।উনারা না বললে আমি কোনোদিন সাহস পেতাম না।
৩) বিদেশে এপ্লাইয়ের জন্য স্টেটমেন্ট অফ পারপাস লেখা একদম সহজ হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই না, আমি এখন এসওপি পড়ে বলে দিতে পারি যে এই এসওপি দিয়ে কদ্দুর আগানো যাবে। যেহেতু প্রচুর বই পড়েছি, কিভাবে শব্দ সাজাতে হয়, গল্প বলতে হয়, এটা নিজের অজান্তেই শিখে ফেলেছি। আমার অন্তত: দশ জন mentee বিশ্বের সেরা সব জায়গায় পড়াশোনা করছে।
ভাল এসওপি লিখে হার্ভার্ড, কলম্বিয়া এবং জর্জটাউনে মাস্টার্স (জর্জটাউনের টা ফুল ফান্ডিং সহ) আর জন্স হপকিন্সে পিএইচডি অফার পেয়েছিলাম। যদিও এ্যাডমিশনে অনেক অনেক ক্রাইটেরিয়া থাকে, কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে আমি অনেক পিছিয়ে যেতাম।
৪) পুলিশে অত্যন্ত সিনিয়র এবং দক্ষ অনেক স্যার আমাকে স্নেহ করেন স্রেফ এই বইপড়ার কারণে। বিপদে আপদে তাঁরা আমাকে নানাভাবে আগলে রেখেছেন। এমনকী আমাদের প্রমোশনের সময়ও শুনেছি এটি বিবেচনায় এসেছিলো- "আমাদের কিছু অফিসার দরকার যারা পড়াশোনা করে, এদের দিয়ে ডিপার্টমেন্টের পলিসি পর্যায়ে অনেক উপকার হবে"- এ ধরনেরর আলোচনাতে আমার নাম ঢুকেছিল, যা পদোন্নতিতে অতি অবশ্যই কিছুটা ভূমিকা রেখেছে।
৫) প্রচন্ড হতাশা আর মন খারাপে বার বার সঙ্গী হয়েছে বই। আমি সান্ত্বনার বানী শুনেছি গৌতম বুদ্ধের ধম্মপদে, মার্কাস অরেলিয়াসের মেডিটেশনে, শ্রীমদ্ভগবদগীতায় কিংবা মাওলানা জালালুদ্দিন রূমীর কবিতায়। তাঁদের বানী আমাকে মাথা তুলে লড়াই করতে সাহস যুগিয়েছে।
৬) বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কিছু মনীষীর স্নেহধন্য হয়েছি স্রেফ এই বই পড়ার কারণে। আমি তাঁদের নাম বলছিনা, শুধু এটুকু বলতে পারি, বই না পড়লে এই মানুষগুলোর স্নেহ দূরে থাক, তাঁদের বাসার সামনের ডাস্টবিনে ঝাড়ু দেবার সম্ভাবনাও থাওতোনা।
৭) ব্যক্তিগত জীবনে বিপরীত লিঙ্গের সাথে আলাপচারিতায় সহজে অংশ নিতে পেরেছি, তাদের সাথে গভীর আলোচনায় যেতে পেরেছি, যা পরবর্তীতে সুন্দর সম্পর্কেও গড়িয়েছে নানা সময়ে। কেউ সাহস করে এটা বলবে না, আমিই বলি, মনের দুয়ার খুললে অন্য সব দুয়ারের চাবি এমনিতেই হাতে আসে। যখন আমার ওই বয়স আর সময় ছিল, বই ছিলো আমার সেই চাবিকাঠি।
৮) আমার ওয়েবিনারগুলোতে শত শত ছাত্রছাত্রী ক্লাস করে তার কারণ আমি প্রচুর রেফারেন্স দিয়ে ক্লাসটা ইন্টারেসিং করতে পারি। এর মূল কারণও বই পড়া।
৯) নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রছাত্রীরা জানেন, আমি ক্লাসে কী পরিমান বুক রেফারেন্স দিই। তাঁরা ইভ্যালুয়েশনে আমাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছেন বলে শুনেছি, এর আসল কারণ ওই বই পড়ে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া।
বই পড়ার অভ্যাস একটা সুপার পাওয়ার। জীবনে যদি উন্নতি করতে চান, বই পড়ুন। পাঁচ মিনিট দিয়ে শুরু করুন, লক্ষ্য থাকবে প্রতিদিন ১০০ পৃষ্ঠা পড়া এক সময়। এইটা যদি আয়ত্তে আনতে পারেন, আপনি অপরাজেয় হয়ে উঠবেন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, বই পড়ুন!
লেখক: শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়