ইবির মত মেরুদণ্ডহীন শিক্ষার্থী আর কোথাও দেখিনি

জিকে সাদিক
জিকে সাদিক  © সংগৃহীত

জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মধ্যে প্রায় ৭ বছর সময় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি। পড়াশোনা তথা বিদ্যা শিক্ষার নামে এক ভড়ংবাজির কারখানায় জীবনের সোনালী সময়ের ৭ বছর দিয়েছি। এই সাত বছরে ইবিতে অমেরুদণ্ডী প্রাণী শিক্ষক যেমন দেখেছি তেমনি ভেড়ার পাল শিক্ষার্থীও দেখেছি।

ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে ও লেখালেখি করার ফলে দেশের অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথেও যোগাযোগ ছিল। মোটামুটি সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অমেরুদণ্ডী শিক্ষার্থী দেখেছি। কিন্তু ইবির মতো ভেড়ার পালে ভর্তি, মেরুদণ্ডহীন, বোধবুদ্ধিহীন জড়চেতনার এতো শিক্ষার্থী আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

নিজ ক্যাম্পাসের একজন শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনায় হাইকোর্ট থেকে শুরু করে দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যম যখন সরগরম; তখনও ইবি শিক্ষার্থীরা নূন্যতম একটা মানববন্ধন পর্যন্ত করেনি। এই ঘটনার বিচার দাবি করে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের যে নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হয়, এসব ঘটনা নিয়েও টু-শব্দ পর্যন্ত করেনি।

আরও পড়ুন: পিএসকে সরিয়ে দিয়ে সপরিবারে ক্যাম্পাস ছাড়লেন ইবি উপাচার্য

আমার দেখা ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন পোলাপান দুটা হালকা নরম-গরম কর্মসূচি পালন করেছে। ছাত্রদল একটা চুপেচাপে মশাল মিছিল করেছে। এর বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নূন্যতম সাড়া নেই।

১৮ হাজার শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনায় সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে একটা কর্মসূচি করা মতো ১০ জন ছাত্রও নাই? অনেকেই বলবেন, আছে কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলে না।

এসব ফাতরামি আলাপ। ইবিতে ২০১৮ সালের শেষে এসে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। তার আগের তিন বছর ইবিতেই ছিলাম। ছাত্র স্বার্থের কোনো আন্দোলন করা বাদ দেইনি। ঘাড়ে এক মাথা নিয়েই কয়েকজন বন্ধু-জুনিয়র-সিনিয়র মিলে আন্দোলন করেছি। প্রশাসনের রক্তচক্ষু থেকে ছাত্রলীগের মারমুখী অবস্থান থাকার পরও আন্দোলন করেছি। তারপর ঘাড়ে ওই একটা মাথাসহই ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়েছি।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের না হয় ভয় লাগে। কিন্তু ইবিতে এতোগুলা স্বেচ্ছাসেবী-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন, তাদের ঐক্য মঞ্চ কই কেউই তো কিছু বললো না? এসব সংগঠনের কাজ কী আসলে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ২-৩শ মালি থাকার পরও সারাদিন খেটেখুটে ক্যাম্পাস ক্লিন করা? বিভিন্ন উৎসবে ফুল দেয়া?

আরও পড়ুন: এখনও তালা ঝুলছে ইবি ভিসির কার্যালয়ে

এসব সংগঠন দিয়ে আসছে ছাত্রদের কী ধইঞ্চাটা হচ্ছে? দিনভর ওয়ার্কশপ করে সিভি লেখা শেখানো। এসবই কাজ? কিছু স্বেচ্ছাসেবা, সামাজিক কাজ এসবের নাম করে তো এসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার বাইরে তেমন কিছুই করছে না। মাঝেমধ্যে দেখি কিছু সংগঠনের লোকজন দিনব্যাপী ক্যাম্পাস ক্লিন করার কাজ করে।

আচ্ছা, ইবিতে যে এতোগুলো ক্লিনার বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে তাদের কাজটা কী তাহলে? শিক্ষার্থীরাই যদি ক্যাম্পাস ক্লিন করবে তো বেতন দিয়ে ক্লিনার রাখার কী দরকার? এই হিসাবটাও যদি এসব সংগঠনের দায়িত্বশীলদের মাথায় আসতো তাহলেও বুঝা যাইতো যে, এরা কিছুটা হলেও চিন্তা করতে পারে।

সম্ভবত ২০১৯ সালের পর ইবিতে নয়া একটা ‘বিপ্লব’ ঘটেছে। সেটা হচ্ছে প্রায় অর্ধশত লেখক তৈরি হয়েছে। রীতিমতো লেখক তৈরির বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেই লেখকদের সংগঠনও আছে। এতগুলো লেখক থাকার পরও একজন লেখকের কলমে এই বিষয়ে একটা লেখা পয়দা হলো না?

সরাসরি ঘটনাকে উল্লেখ্য করে কেউ কিছু লেখেছে বলে চোখে পড়েনি। লেখলে ভালো। তবে ঘরের পাশে মানুষের পিঠে ঘাস উঠে গেলেও যে লেখকের কলমে তা ধরা পড়ে না সেই লেখককূলকে ধইঞ্চা বললে মানে লাগবে?

নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিপীড়ন নিয়ে দুকলম লেখার সাহস বা মুরোদ না থাকলে সেই মানের লেখক কী করে ভাবে তার লেখায় দেশের বিরাট কাজে দেবে? এসব সভাকবি মার্কা লেখক দিয়েই বা কী হবে?

আরও পড়ুন: ইবির হলে ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতন ছাত্রলীগের, ভিডিও ধারণ

আরো কতগুলো সংগঠন আছে, যেগুলোর কাজই মানব সেবা করা। সেবার মাধ্যমে বন্ধুত্ব। শিক্ষার্থী নিপীড়নের বিরুদ্ধে নূন্যতম প্রতিবাদ করা কি সেবার কাজের মধ্যে পড়ে না? নরম সেবার সবাই হাত তালি দেয়, বাহবা দেয় আর সেটা একটু গরম হলে চুপ থাকতে হয়?

আমি সম্ভবত ২য় বর্ষেই বুঝেছিলাম এসব সংগঠন একেকটা ধইঞ্চা মার্কা কাঠামো ছাড়া কিচ্ছু না। এসবের নূন্যতম আবেদন নাই। তখন থেকে মোটামুটি সব সংগঠন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। স্টাডি সার্কেলের মতো করে একটা সংগঠনই করেছি সেটা হচ্ছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ।

এর বাইরে কিছু সংগঠনকে যখন দেখলাম লোক দেখানো মানসিকতার, পাতলা চিন্তার, বাহবা পাওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করা নেতৃত্বের হাতে গিয়ে পড়লো তখন থেকে একমাত্র ছাত্র ইউনিয়ন করা বাদে আর কোনো সংগঠন করি নাই।

কারণ এসব সংগঠন তো শিক্ষার্থীদের নূন্যতম কাজেও আসছে না। বরং পড়াশোনা বা ভালো কিছু করার সময়টা হাত দিয়ে টুটি চেপে ধরে হত্যা করার মতো করে নষ্ট করছে।

একটা ক্যাম্পাস কতটা বদ্ধ পরিবেশের হলে এমন পরিস্থিতি হয় তা কল্পনায় আনা যায়? কতটা পঁচা-গলা-গঁদবাধা চিন্তা-চেতনার বিদ্যা শিক্ষার্থী হলে এমন হওয়া যায়? বিদ্যা শিক্ষার কী সুকৌশলী ভড়ংবাজী! এসব সংগঠনের বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের শেষ অংশটুকু দারুণ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

‘হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।’

শেষে একটা কথা, সব স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে আমার এক পেশে সমালোচনায় কেউ মন খারাপ করলে আমারও খারাপই লাগবে। তবে আমি দুঃখিত নই। দ্বিমত থাকলে বলবেন বা আমি ভুল বললে পয়েন্ট ধরিয়ে দেবেন।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ