‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’
‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তোমার জন্য গলির কোনে; ভাবছি তোমায় মুখ দেখাবো, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ শঙ্খ ঘোষ তার প্রেয়সীকে মুখ দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু তা ঢেকে গিয়েছিল বিজ্ঞাপন আর প্রজ্ঞাপনে। এমনটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে হলে তা আপাত অর্থে মানা যায়, কেননা ব্যক্তির চেয়েও বড় তার দেশ; তার চেয়েও বড় তার সত্ত্বা, জাতির-সত্ত্বা, জাতিসত্তা। মানুষের শুভ চিন্তা, শুভ কাজগুলোই যখন গণ মানুষের দাবিতে রূপ নেয়, তখন তা আর মানবের একার থাকে না; ব্যক্তি, গোষ্ঠিকে ছাপিয়ে জাতির সত্ত্বার অস্তিত্বতে মিশে যায়। তখন অতীত হঠাৎ করে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরোজায়, জানতে চায় তা সত্ত্বাকে।
বাঙালির অতীত সত্ত্বা তালাশ করতে গেলে শকুনের আলখাল্লা যে কত বড় তার নজির পাওয়া যাবে; আপাতত সেই ঐতিহাসিক মোড়ে না গিয়ে প্রজ্ঞাপনের ছোট গলিতে গিয়ে বাঙালির সত্ত্বা তালাশ করা দরকার; কেননা আমাদের মুখ ইতোমধ্যে বিজ্ঞাপনে ঢাকিয়া গিয়াছে এবং বাকী দেহখান প্রজ্ঞাপনে আড়াল হইয়াছে, ‘কারণ’ খুঁজতে গিয়ে ফলাফলখানাও গায়েব হইয়াছে বহুকাল আগেই।
মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার স্বীকৃতি মিলেছে। সেটা কি সত্যিকারের স্বীকৃতি? প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ উপনিবেশবাদের মতো ভাষারও সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং উপনিবেশবাদ রয়েছে। পাকিস্তানি আমলে বাংলাভাষা কখনো গণতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করেনি।
সমুদ্রের জল থেকে যেমন নীলকে হেঁকে আলাদা করা যায় না, তেমনি একটি জনগোষ্ঠীর থেকে তার ভাষাকেও আলাদা করা অসম্ভব। একটি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, জলহাওয়া, মৃত্তিকা, নদনদী, কল্পকথা, রূপকথা কত কিছুর মধ্যে শিকড়িত একটি ভাষা। বটবৃক্ষের মূল ঝুরি কেটে কাণ্ড এবং ডালপালাকে যদি বটবৃক্ষ বলে অভিহিত করা যায়, তাহলে পাকিস্তানি আমলের বাংলাও মূলহীন ডালপালাসর্বস্ব রাষ্ট্রভাষাই ছিল।’
আহমদ ছফা যেসব প্রশ্ন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেখেছেন; তার কী খুব বেশি উন্নতি হয়েছে? ছফা বলেছেন: ‘পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রবক্তাবৃন্দ, যারা ইকবালকে চালু করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বদলে, সুসভ্য মানুষের জন্য দোভাষী পুঁথি আমদানি করেছেন, জঙ্গিলাট আয়ুব খা-ও কবিতার রসিক একথা অপরকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, মহাপুরুষ, আদমজী-দাউদেরা সাহিত্যের সমঝদার এ কথা ভুল করে ঠিক ঠাউরেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। পুষ্প চন্দন বর্ষিত হোক শিরে, তাদের পদোন্নতি ঘটুক সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগে।
তারা বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করেছেন এবং সাফল্যজনকভাবে অনেকগুলো চক্ৰ উপচক্রের জন্ম দিতে পেরেছেন দয়া করে তারা বিশ্রাম করুন । আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতিকে ক্ষমা করে সত্যি মহত্ত্বের পরিচয় দেবেন, রক্তস্নাত বাঙালি জাতি এটা স্বাভাবিকভাবেই আশা করে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, যদি অসুবিধা না হয় আমাদের সংস্কৃতির প্রাক্তন মুরুব্বিদের কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিন। দেশে থাকলে তাদের ক্লান্ত মস্তকগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। যাবজ্জীবন ধরে সাম্প্রদায়িকতার বেসাতি করে যাদের নাম ধাম খ্যাতি এবং পদোন্নতি, তারা যদি পুরনো আসনগুলোতে নড়ে চড়ে ফের বসেন তাহলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভরাডুবি হবে।’—আজকের বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের এমন ভরাডুবির কথা ছফা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আজ থেকে ৫০ বছর আগে এবং ভাষা আন্দোলনের ঠিক ২০ বছর পর।
মানবের শুভ চিন্তাগুলো যদি কখনো ঢেকে যায় অশুভ মেঘে কিংবা চটকদার ভিন্ন বিজ্ঞাপনের আবরণে; তাহলে বুঝতে হবে ‘পৃথিবী ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হইয়াছে এবং এরপর পাকিস্তানিরা বাঙালিদের শোষণ করিয়াছে এ রকম একচেটিয়া ইতিহাস তত্ত্বে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার ইতিহাস আড়াল হইয়াছে।’ আমি বাড়িয়ে বলছি না; বাঙালির জাতিসত্তা বা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের উত্থান কি—এমন জিজ্ঞাসার সহজ জবাব যদি হয় ‘ভাষা আন্দোলন;’ তাহলে সেটি মিথ্যা।
আর তা সত্য হলে, আজকের বাংলাদেশে বাংলা ভাষার এ রকম দুরবস্থা হতো না। পাকিস্তান আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভূমিকা, অর্থাৎ ভাষা সংগ্রামের পূর্বে তার আন্দোলন আমরা এতো তাড়াতাড়ি ভুলিয়া গেলাম। আমরা এখন এতো-তাই বুর্জোয়া হয়েছি যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথা আমরা ভুলতে পারলেই আমরা এখন বাঁচি।
ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর আমরা উর্দু চায়নি বলেই তো বাংলার কথা বলেছিলাম; সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবিতে বাঙালির স্বাধিকার সত্ত্বা আন্দোলিত হয়েছিল তখন। তার পরবর্তীতেই ভাষা আন্দোলন থেকে শক্তি নিয়েই বাংলাদেশের পরবর্তীতে সৃষ্টি-পূর্ব আন্দোলনগুলো সংগঠিত হইয়াছে। এখন সে সত্যকে জিইয়ে রাখতে হলে সর্বস্তরে বাংলা চালু রাখা হবে অতি জরুরি কাজ। কিন্তু তা যেহেতু করা হয়নি, অর্থাৎ সর্বস্তরে যেহেতু বাংলা চালু করা যায়নি, সেহেতু ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে’ এমন দাবি নতুন করে তোলার ফলে বায়ান্নকে নতুন করে অপমান করা হবে।
ফলে আমরা একটি জটিল ধাঁধাঁর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। তা হচ্ছে সর্বস্তরে বাংলা চালু না করার ফলে বা করতে না পারার ফলে ১৯৪৭ এর উর্দু-জোরালো বাংলা আর বর্তমানের স্বাধীন বাঙালি অধ্যুষিত ‘স্বাধীন বাংলা’র কোনো পার্থক্য নাই; এটিকে যদি সত্য ধরা হয় তাহলে ভাষা আন্দোলন বা বাঙালি জাতীয়তাদের উত্থান হয়েছে বায়ান্ন থেকে তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। আবার তাকে স্বীকার করে যদি সর্বস্তরে বাংলা চালু করা হয় তাহলে আমাদের নতুন করে জুজুর ভয় দেখানো হয় যে, ‘ইংরেজি না পড়লে আমাদের ছেলেরা পিছিয়ে যাবে।’
তাহলে আবারও জিজ্ঞাসা, চীন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপান কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন এখন করা যায় না। এখন সর্বস্তরে বাংলা চালু করা হলে জুজুর ভয় আর না করলে পাকিস্তান থাকাকালে সেই উর্দু থাকারই জয়-এমন গোলক ধাঁধাঁর তাহলে সমাধান সেই পুরোনো কথা, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করা।’ যদি তা-না করা হয়, তাহলে আপনি বাঙালির সত্ত্বাকে অস্বীকার করছেন- এখন আমরা যদি এমন কথা বলি তাহলে আমাদের ইমান আর অব্যাহত থাকবে না; কেননা আমরা ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির নামে তার প্রধান চরিত্র পরিবর্তন করে দিয়েছি। কেননা তা ‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস’ না হয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হয়েছে। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি হচ্ছে, এখন পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার জন্য দিবস পালন করা হয় শুধুমাত্র বাংলার জন্য নয়। এটি একটি অপ্রিয় সত্য হলেও আপনাকে কষ্ট করে গিলতে হবে।
এখন ছোট করে হিসেবে আসা যাক আমরা এ অবস্থায় আসলাম কিভাবে? আমাদের একটি বাংলা একাডেমি আছে, পশ্চিম বঙ্গেরও (ভারতের) একটি বাংলা একাডেমি আছে। বাংলা ভাষার উন্নয়নে তার কাজ করার কথা থাকলেও তারা আসলে কী করছেন-সচেতন বাঙালি মাত্রই তা খুব ভালো করে জানেন। ‘একাডেমি’ হবে নাকি ‘আকাডেমি’ হবে তার সমাধান আজও হয়নি। ‘গরু’ নাকি ‘গোরু’ তার তত্ত্ব তালাশ করতেই ব্যস্ত আমাদের সেন্সরশিপ নিয়ে মহাজনী করা একাডেমি। বইমেলায় কারা স্টল পাবে আর কারা পাবে না তার দায় অন্তত একাডেমির না; এটা তো সত্য।
কোন বই নিয়ে সমস্যা থাকলে আপনি কিছু করতে না পারলে তার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজনে আদালতে যেতে পারেন; কিন্তু তার সব বই মেলায় বেচা বন্ধ করার মতো ‘সেন্সনশিপ’ আপনি যেভাবেই দেন-সহজ কথায় তা আপনার কাজ নয়। ‘কি’ এবং ‘কী’ এর পার্থক্য জিজ্ঞেস করলে তার মুখস্থ জবাব ‘হ্যাঁ অথবা না’ কিংবা ‘বিস্তারিত ব্যাখ্যা’। সহজ যুক্তি রবীন্দ্রনাথ বলেছে; রবীন্দ্রনাথ বললেই তা কোন তত্ত্ব-তালাশ না করে কেন গ্রহণ করা হবে? তার কোন জবাব নেই। এর দায় আরও বেশি আমাদের গণমাধ্যমগুলোরও। তারাও এতে ভূমিকা পালন করছে; দায় তাদেরও আছে। এখন কথা হচ্ছে, গোঁফ দেখে যদি বিড়াল চেনা যায়, তাহলে এদের চিনতে খুব বেশি মাথা খাটানো লাগবে না; শুধুমাত্র দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় হাত দিলেই হবে।
এ অবস্থা একদিনে হয়নি বা একা কারো দ্বারা হয়নি; একটি দৃঢ় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে, সে সত্যও আমাদের স্বীকার করতে হবে এবং সমাধান করতে হবে। তাতে যদি চরম মিথ্যা দিনে একটি সত্য বিজ্ঞাপনে আড়াল হওয়া আমাদের বাংলা ভাষার বিজ্ঞাপন প্রচার করার সত্য যদি ফিরিয়ে দেয়। কেননা বায়ান্নর লড়াইয়ের গৌরব যদি আমাদের হয়; ব্যর্থতার দায়ও আমাদেরই। সে সত্য স্বীকারের মাধ্যমেই বিজ্ঞাপনে আড়াল হওয়া মুখখানি কিছুটা বের করা যাবে, নাহলে এভাবেই ‘মুখ ঢাকিয়া যাইবে বিজ্ঞাপনে’।