ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ (সা:)

ডি এইচ মান্না
ডি এইচ মান্না  © টিডিসি ফটো

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ দোজাহানের বাদশাহ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। ৫৭০ খৃষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মক্কা নগরী যার আগমনে ধন্য হয়েছিল। মা আমেনার কুলকে আলোকিত করেছিলেন যে শিশু, কে জানত এই শিশুই আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হবেন। 

পরশপাথর যেথায় লাগে সেথা নাকি স্বর্ণ হয়ে যায়। ১২ রবিউল আউয়ালে মক্কার ঐ অনুর্বর অনাবাদি ভূমিতে নবী মুহাম্মদ (সা.) আগমনে সতেজতার স্নিগ্ধ হাওয়া লেগেছিল। উনার পায়ের স্পর্শে ধন্য হয়েছিল মরুর পথগুলো। আরবের বালিকণাগুলোও কত সৌভাগ্যবান ছিল যে সেই আরবের মাটি হতে না পারার ব্যাকুলতা নবী প্রেমী কোটি উম্মতের হৃদয়কে স্পর্শ করে। সেই ব্যাকুলতা থেকেই  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন 'আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ, এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত'।

আরও পড়ুন: নবীকে কটূক্তি করায় সন্তানকে ত্যাজ্য করলেন বাবা

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় ছিলেন মাত্র ৬৩ বছর। এই ৬৩ বছরের আয়ুকাল সাধারণ কোনো মানুষের আয়ুকালের সাথে অতুলনীয়। কারণ বিশ্বনবী ৬৩ বছরের আয়ুকালের পরিধি ব্যাপক যা একসাথে আলোচনা কিংবা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। প্রিয় নবীর জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি কাজ, কথাবার্তা, চলাফেরা, প্রতিটি কার্যক্রমের পিছনে বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। 

তার জীবনের প্রতিটি পর্যায় মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা। জন্ম থেকে শিশুকাল, বালক থেকে যুবক জীবনের যে কোনো মঞ্জিলে তিনি হলেন সর্বোত্তম আদর্শের ধারক।

নবীজীর শিশুকাল:

৫৭০ খৃষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল মক্কার সবচেয়ে বনেদি কুরাইশ গোত্রের হাশেমি বংশে আবদুল মুত্তালিব এর পুত্র আব্দুল্লাহ ও মা আমেনার ঘরকে আলোকিত করে শিশু মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম। সেই সময় আরবের ধাত্রী প্রথা অনুযায়ী দুধ পানের জন্য বনু সাদ বংশের ধাত্রী হালিমার গৃহে পাঠানো হয়। অবশ্য মুহাম্মদ (সা.) জন্মের পর প্রথমে আপন মাতা আমিনা এবং কিছুদিন পর চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেছিলেন। এরপর পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশু মুহাম্মদ (সা.) ধাত্রী হালিমার কাছেই ছিলেন।

মহানবী সম্পর্কে মা হালিমা বলেছিলেন, আমি শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে আমার ঘরে আনার পর সব অভাব মোচন হয়ে যায়। তাকে আনার পর আমার উভয় স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। উটনির স্তনগুলো দুধে ভরে গেল। আমাদের গাধা (বাহন)টি দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে গেল। বকরিগুলো চারণভূমি থেকে ভরা পেটে ও ভরা স্তনে ফিরে আসত।' এভাবেই শিশু মুহাম্মদ সা:'র মহিমা এক এক করে প্রকাশ হতে থাকে।

নবী মুহাম্মদ (সা.) শিশুকাল থেকেই এতটা ইনসাফবান ছিলেন যে, যখন হালিমার স্তন্য পান করতেন, তখন মাত্র একটি স্তনই পান করতেন। অপর স্তনটি তার দুধভাই হালিমার আপন শিশুপুত্রের জন্য রেখে দিতেন। অবুঝ শিশুর অধিকার প্রদানের এমন কাহিনী পৃথিবীতে বিরল।

হালিমার গৃহে থাকাকালীন মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হয়েছিল। হালিমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি ছাগল-মেষ চরাতে যেতেন। কিন্তু শিশু উপযুক্ত ক্রীড়া-কৌতুকে বা কলহে যোগদান করতেন না। তখন থেকেই তাঁর মধ্যে আত্মসমাহিত ভাব এবং ভাবুক প্রকৃতির উন্মেষ হয়েছিল।

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় বিশ্বনবী জন্মের পূর্বেই পিতা হারান। ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে পিতা আবদুল্লাহ'র কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে মা আমেনাও ইন্তেকাল করেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে 
এতিম হয়ে যান শিশু নবী মুহাম্মদ (সা.)।

পিতা-মাতা হারানোর পর মহানবীর মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়ালেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। কিন্তু সেই ছায়াও আর বেশি দিন থাকলো না। ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে দাদা আবদুল মুত্তালিব ও ইন্তেকাল করলেন। 

তারপর  নতুন অভিভাবক পেলেন মুহাম্মদ (সা.)। দাদার মৃত্যুতে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে আসেন। ১২ বছর বয়সে ব্যবসা উপলক্ষে চাচার সঙ্গে প্রথম সফরে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন মুহাম্মদ (সা.)। 

যাত্রাপথে সিরিয়ার তায়মা নামক স্থানে নবীজি (সা.) বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জনৈক ইহুদি পণ্ডিত বুহায়রা রাহিব নবীজি (সা.)কে দেখে থমকে গেলেন। চাচা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, বালকটি কে?

আবু তালিব ভাতিজার পরিচয় দিলেন। ইহুদি পণ্ডিত বললেন, ‘সিরিয়া গেলে ইহুদিরা তাঁকে মেরে ফেলবে। এ বালক বড় হয়ে আল্লাহর নবী হবে। তাওরাতকে সে রহিত করে দেবে এবং ইহুদি ধর্মযাজকদের রাজত্বের অবসান ঘটাবে।’

ধর্মীয় কিতাব তাওরাতে মহানবী (সা.) এর পূর্ণ অবয়ব ও আকৃতির বিস্তারিত বিবরণ ইহুদিদের জানা ছিল। এ সময় একজন নবী আসবেন, তাও তারা জানতো। আশঙ্কিত আবু তালেব সিরিয়া সফর বাতিল করে মক্কায় ফিরে আসেন।

রাসুল (সা.) শিশুকাল থেকেই অত্যন্ত লাজুক ও পরম সত্যবাদী ছিলেন। তখন মক্কার মানুষ তাকে আল-আমীন হিসেবে উপাধি দেয়। আল-আমিনের বাংলা অর্থ সত্যবাদী। তিনি কখনো এই সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উন্নত চরিত্রের অধিকারী। 

শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)এর জীবনাদর্শ কালোত্তীর্ণ শাশ্বত এবং সর্বোত্তম। সমাজ, বাস্তবতা, পারিবারিক জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড সব ক্ষেত্রেই নবীর পদচারণা ছিল অনুকরণীয়। তাই মহানবী 
(সা.) হচ্ছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী।

লেখক- তরুণ সাংবাদিক ও ফিচার লেখক


সর্বশেষ সংবাদ