বর্তমানদের নির্মমতার শিকার ঢাকা মেডিকেলের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

হামলায় গুরুতর আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এএসএম আলী ইমাম
হামলায় গুরুতর আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এএসএম আলী ইমাম  © সংগৃহীত

এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে ছাত্রলীগের সাবেক নেতার ওপর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সহপাঠীদের হাতেই নির্মমতার শিকার হয়েছেন এএসএম আলী ইমাম (শীতল) নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক। তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সারা শরীরে কিল-ঘুষি-লাথি মারা হয়। মাথায় আঘাতের একপর্যায়ে বমি শুরু হলে তাকে টিভি রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত এ ঘটনা চলে।

এর সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগ এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সেদিন বেঁচে ফিরলেও জীবন রক্ষায় শীতল ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছেন। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাঁর শিক্ষাজীবন। শীতল থানায় মামলা করায় নির্যাতনের তথ্য মেডিকেল কলেজের বাইরে চলে আসে।

এ ঘটনায় ১৭ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। পরের ৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও কমিটি আরও ১০ দশ দিন সময় বাড়িয়েছে।

ঘটনা জেনেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। তবে তিনি এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বুয়েটের ছাত্রাবাস শের-ই-বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তাকে ডেকে নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে তার মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে যা বিচারাধীন।

মারধরের শিকার ডা. এএসএম আলী ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমি মেডিসিন বিভাগের মাধ্যমে ইন্টার্ন শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহরিয়ার খান আমাকে মেডিসিন না দিয়ে সার্জারিতে দেন। কেন আমাকে মেডিসিন দেওয়া হলো না জানতে চাওয়ায় তিনি দলবেঁধে আমার ওপর নির্যাতন চালান। আমি ঢামেকের ২০১৬-১৭ সেশনের ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ছিলাম। বর্তমান কমিটির নেতারা এবং আমি ভিন্ন গ্রুপ করায় আমার ওপর এভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। জীবন বাঁচাতে আমি এখন গ্রামের বাড়িতে আছি। তারা বলেছে, আমাকে ঢামেকে ঢুকতে দেবে না, ইন্টার্নও করতে দেবে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (প্রাক্তন শিক্ষার্থী কে-৭০ ব্যাচ) শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ মো. আল-আমিন বলেন, ফজলে রাব্বি হলে কোন রুমে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় এটা আমার জানা নেই। আমাদের হলে গেস্ট রুম আছে, কমনরুম আছে কিন্তু নির্যাতনের কোনো রুম নেই। তা ছাড়া যখন মারামারি হয় তখন আমি রুমে ছিলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই মারামারি শেষ হয়ে যায়। ডিউটি রোস্টার নিয়ে ওদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। বিষয়টি আমি পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে মীমাংসা করে দেব বলে জানাই। এএসএম আলী ইমাম আগের কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক ছিল। 

জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ঢামেক কে-৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান আলী ইমামকে ডেকে নিয়ে যায় ফজলে রাব্বি হলের ক্যান্টিনের পুকুর পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই অনেক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। ইন্টার্নের দায়িত্ব নিয়ে কথা শুরু হয়। এখানে তাকে মারতে থাকে। এক পর্যায়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি কে-৭০ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ মো. আল-আমিনের নির্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হলের টিভি রুমে। সেখানেও কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিউল ইসলামের নেতৃত্বে শাহরিয়ার খান, ফয়সাল ইফতিসহ কয়েকজন তাকে নির্মমভাবে মারতে থাকে। চিৎকার শুনে একই ব্যাচের বন্ধুরা বাঁচাতে এলেও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ মো. আল-আমিনের প্রতিরোধে কেউ ওই রুমে ঢুকতে পারেনি। তিনি রড হাতে নিয়ে দরজার বাইরে পাহারা দেন। একপর্যায়ে মাথায় আঘাত লাগার কারণে তার বমি শুরু হয়। এ সময় তড়িঘড়ি করে তাকে টিভি রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তার বন্ধুরা তাকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকায় বন্ধুদের সহযোগিতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায় শীতল। তার বন্ধুদের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, সে যেন আর কলেজে ফিরে না আসে। ঢামেক হাসপাতালে তার ইন্টার্ন হবে না।

কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিষয়টি হল প্রভোস্টের নজরে আনেন। প্রভোস্ট তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি দেখছেন বলে জানান। শিক্ষার্থীরা বলেন, এটাই প্রথম ঘটনা নয়। গত সেপ্টেম্বরে ঢামেক শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শুরু করে গ্রুপিং। যে তাদের কথা শোনে না তার ওপরই নেমে আসে নির্যাতন।

এ ঘটনায় ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ঢামেকের নাক-কান-গলা ও হেড নেক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমী ওই কমিটির প্রধান এবং বাকি চার সদস্যরা হলেন গাইনি এবং অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. শিখা গাঙ্গুলী, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ কাশেম, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচএ নাজমুল হাকিম ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. আলাউদ্দিন।

নির্যাতনের শিকার ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম ২৫ জানুয়ারি তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, অজ্ঞাত অনেকে আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে হলের মূল ভবনের কমনরুমে নিয়ে যায়। সেখানে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ডা. আল-আমিন (কে-৭০) আমাকে চড় মারে এবং একটি রড ডা. শাহরিয়ারের হতে তুলে দেয়। তিনি শুধু কে-৭২ ব্যাচের উপস্থিত ছাত্রদের মারতে নির্দেশ দেন। ক্রমাগত আঘাতের একপর্যায়ে আমি আরও দুবার বমি করি। আমার দুই পায়ে মারাত্মক জখম হয়ে রক্তপাত শুরু হয়। একপর্যায়ে আমাকে রুম থেকে বের করে দেয়। আমার সহপাঠী বন্ধু শফিকুল আলম এবং নাহিদা হাসান ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। যেখানে আমার দুই পায়ে সেলাই করা হয়। হলের কমনরুম/গণরুমসংলগ্ন একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরায় ওই দিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ধারণকৃত ফুটেজ দেখলেই আমার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যাবে। আমার ওপর হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় করা হয়েছে।’

তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হয়ে লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যে ডা. শাহরিয়ার খান বলেন, ‘ইন্টার্ন ইনডাকশন এবং রোটেশন নিয়ে ডা. আলী ইমাম শীতল আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি ফাঁকা জায়গায় তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। হঠাৎ করে সে আমার মাথায় বেসবলের ব্যাট দিয়ে আঘাত করে। আমার চিৎকার শুনে কে-৭২ ব্যাচের আতিকুল ইসলাম এবং ডা. ইমামসহ অন্যরা আমাকে উদ্ধার করে। এ সময় ডা. আলী ইমামের সঙ্গে আমার উদ্ধারকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়।’

শাহরিয়ার খানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা হয়েছে। স্যাররা আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন।

তদন্ত কমিটিকে ফুয়াদ মৌখিকভাবে জানান, ইন্টার্ন রেজিস্টার নিয়ে শীতল ও শাহরিয়ারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। দুজনেই আহত হন। শাহরিয়ার জানান, খসড়া তালিকা নিয়েই তার সঙ্গে শীতলের ঝগড়া সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া তদন্ত কমিটি জানতে পারে ঘটনাস্থলে কে-৭২ ব্যাচের ডা. গৌরব বিশ্বাস, ডা. শাশ্বত চন্দন, কে-৭৩ ব্যাচের ফয়সাল, এছাড়া ডা. আতিকুল ও ডা. ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

২৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি ঢামেক হাসপাতালের পরিচালককে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি জানান, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রাসঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন। এর জন্য প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা আরও ১০ দিন বাড়ানোর অনুরোধ করা হলো।

এ বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমী।

গত ১৭ জানুয়ারি নির্যাতনের শিকার ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম নিজেই চকবাজার মডেল থানায় মামলা করেন। ডা. শাহরিয়ার খান, ডা. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ, ফয়সাল ইরতিজা, ডা. শেখ সোহেল, ডা. ইশমাম আহমেদ, ডা. সৈয়দ হাসান ইভেন, ডা. ইব্রাহিম হাওলাদার, ডা. তানভীর আহমেদ আকাশসহ অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করেন আলী ইমাম।

চকবাজার থানার পরিদর্শক মওদুদ হাওলাদার বলেন, ফজলে রাব্বি হলে মারামারির ঘটনায় একটি হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষ হলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।