বিদেশের ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে সন্দেহ

প্রতীকী
প্রতীকী

১২ জন বাংলদেশি চিকিৎসক চীনের একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে যে এমবিবিএস সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন তা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। বিদেশ থেকে যারা এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন করিয়েছেন তাদের সবার সনদ আবার পরীক্ষা করার কথা ভাবছে তারা।

বিএমডিসির নির্বাহী সদস্য ডা. ইকবাল আরসালান খান জানান, এজন্য বিএমডিসিসির আইন পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। কারণ, অভিযোগ না পেলে নিজ উদ্যোগে কোনো কিছুর তদন্তের ক্ষমতা বিএমডিসির নেই। তার ধারণা, এরকম আরো ভুয়া বিদেশি এমবিবিএস ডিগ্রিধারী থাকতে পারেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আরো কিছু অভিযোগ আছে।আমরা তার তদন্ত করছি। শুধু বিদেশি নয়, বাংলাদেশের কিছু এমবিবিএস সার্টিফিকেট নিয়েও অভিযোগ আছে।’’

এর আগে রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম তিনটি ভুয়া এমবিবিএস সার্টিফিকেট ধরা পড়েছিল বলে বিএমডিসি সূত্রে জানা গেছে।

এবার যে ১২ জনের ভুয়া সার্টিফিকেট ধরা পড়েছে, তারা চীনের তাইসান মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস পাসের সার্টিফিকেট দাখিল করে বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন নিয়েছিলেন। দুদক ওই ১২জন এবং বিএমডিসির সাবেক রেজিষ্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদুল হক বসুনিয়া ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

ধরা পড়া ১২ জন ভুয়া চিকিৎসক হলেন, কুমিল্লার বড়ুরা উপজেলার মো. ইমান আলী ও মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সুদেব সেন, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর তন্ময় আহমেদ, ভোলার দৌলতখানের মো. মাহমুদুল হাসান, চাঁদপুরের মতলবের মো. মোক্তার হোসাইন, ঢাকার সাভারের মো. আসাদ উল্লাহ, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মো. কাউসার, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রহমত আলী, বাগেরহাট সদরের শেখ আতিয়ার রহমান, ফেনীর দাগনভুঁইয়ার মোঃ সাইফুল ইসলাম এবং সিরাজগঞ্জ সদরের মো. আসলাম হোসেন।

এই জালিয়াতির ঘটনা আড়াই বছর আগে প্রথম যখন ধরা পড়ে বিএমডিসি তখনই ১২ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছিল। তারা এখন পলাতক।

জালিয়াতির উৎস

বাংলাদেশের যারা বিদেশ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নেন, তাদের বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন পেতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সার্টিফিকেট সত্যায়িত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএমডিসিতে আবেদন করতে হয়। এরপর বিএমডিসি একটি পরীক্ষা নেয়। পরীক্ষায় পাশ করলে প্রথমে ইন্টার্নি করার জন্য সাময়িক এবং ইন্টার্নি শেষ হলে স্থায়ী রেজিষ্ট্রেশন পায়। কিন্তু বিএমডিসি নিজ উদ্যোগে তাদের ওই সার্টিফিকেট আর চেক করতো না।

দুদকের মামলার আসামি ওই সময়ে বিএমডিসির রেজিষ্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদুল হক বসুনিয়া বলেন, ‘‘যেহেতু দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভেরিফাই করে দিত, তাই আমরা আর চেক করার প্রয়োজন মনে করতাম না। ওই জালিয়াতি ধরা পড়ার পর আমরা নিয়ম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠান থেকেও সার্টিফিকেট চেকের নিয়ম করি। তবে আরো আগে আমরা বিদেশি সার্টিফিকেট সরসারি গ্রহণ করতাম। কোনো ধরনের চেকই করা হতো না।’’

ডা. ইকবাল আরসালান খান বলেন, ‘‘আসলে আমাদের সিস্টেমে গলদ ছিল। আমরা যদি নিজেরা প্রতিষ্ঠান থেকে আগেই চেকের ব্যবস্থা করতাম, তাহলে এই জালিয়াতি সম্ভব হতো না।’’

নানা পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এই জালিয়াতি কয়েক পর্যায়ে হতে পারে। প্রথমত, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই একটি চক্র থাকতে পারে যারা ভুয়া সার্টিফিকেটের ব্যবসা করে। কিন্তু তাদের সাথে দূতাবাসের লোকজন জড়িত না থাকলে সেটা সত্যায়ন করা সম্ভব নয়। আবার এই ভুয়া ডিগ্রিধারীদের বিএমডিসির পরীক্ষায় পাস করাও বিস্ময়কর। তাই বিএমডিসির কোনো চক্রও এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। আবার সার্টিফিকেট, দূতাবাসের সত্যায়ন থেকে শুরু করে সবকিছুর পেছনেই দেশে একটা সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে থাকতে পারে। বিএমডিসিতে এটা দেখার দায়িত্ব রেজিষ্ট্রার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার।

তবে রেজিষ্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদুল হক বসুনিয়া দাবি করেন, ‘‘আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তখন যে নিয়ম ছিল সেই নিয়ম মেনেই ওই ১২ জনকে রেজিষ্ট্রেশন দেয়া হয়েছিল। পরে আমরাই জালিয়াতি ধরতে পারি।’’

তবে ডা. ইকবাল আরসালান খান বলেন, ‘‘ওই ১২ জনের বিরুদ্ধে আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছিলাম। চীনের ওই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্র লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আমরা সত্যতা পাই।’’

তখনই থানায় মামলা করা হলেও তারা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এখন দুদক তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে হয়তো জালিয়াতির পুরো চিত্র জানা যাবে বলে মনে করেন তিনি। দুদক তাদের তদন্তের অংশ হিসেবে ১২ জনের সার্টিফিকেট গত বছরের জানুয়ারি মাসে বেইজিং-এ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই করে ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়। সনদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তারা রেজিষ্ট্রার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে।

ইকবাল আরসালান খান বলেন, ‘‘এক লাখ পাঁচ হাজার ডাক্তার ও ডেন্টিস্ট বিএমডিসির রেজিষ্টার্ড। এই নিবন্ধন ছাড়া বাংলাদেশে কোনো চিকিৎসক প্র্যাকটিস করতে পারেন না। এর মধ্যে একটি অংশ বিদেশ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। আগে যে প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন দেয়া হয়েছে তাতে এরকম আরো ভুয়া চিকিৎসকের রেজিষ্ট্রেশন নেয়ার আশঙ্কা করছি।’’

তিনি জানান, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে নিয়মের বাইরে ভর্তি হয়েও অনেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়েছেন। রেজিষ্ট্রেশনও নিয়েছের তারা। এখন তাদের ব্যাপারেও তদন্ত হচ্ছে।

বিএমএ-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘এই ঘটনায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। পুরো বিষয়টি নিয়ে আরো গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এটা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ