২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:০৬

লাশ কাটেন যিনি, তিনিও মানুষ

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গের ডোম (বাম থেকে) মাহে আলম ও তার সহযোগীর সাথে প্রতিবেদক নাজিমুল হক সানি   © টিডিসি ফটো

লাশকাটা ঘর কিংবা লাশ কাটেন যারা তাদের নিয়ে আমাদের সবারই বেশ আগ্রহ রয়েছে। তাদেরকে আমরা অনেকেই দেখি ভয়ের চোখে। তাদের সম্পর্কে জানার কৌতূহল থেকেই আমরা ছুটে গিয়েছিলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে। রহস্যময়, ভয়ংকর এক লাল দরজা। লাল দরজার পেছনের কক্ষটা মুখরিত থাকে মৃত মানুষের আনাগোনায়। সামনে কতকগুলো কফিন। কোনটা লাল, কোনটা আবার গাঢ় খয়েরী। লাশ মোড়ানোর জন্য রাখা আছে খেজুর পাতার চাটাই। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের টিচিং মর্গের চিত্র এটি।

এখানেই ডোমের পেশায় জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন মাহে আলম। বয়সের ছোঁয়া লেগেছে শরীরে। হালকা গড়নের শ্যাম বর্ণ দেহ, তৈলাক্ত চুল, মুখে কিছু দাড়ি, হাসি-খুশি মুখ। এ যেন মাহে আলমের সার্বিক চিত্র!

৩৭ বছর ধরে লাশ কাটেন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে চাকরির আগে দেশের বিভিন্ন সদর হাসপাতালে ডোমের দায়িত্বে ছিলেন মাহে আলম। প্রায় তিনহাজার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে তার হাত ধরেই। মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের কাছে মাহে আলম মামা প্রিয় এক চরিত্র। কেননা, তার হাত ধরেই শিক্ষকের তত্ত্বাবধায়নে ময়নাতদন্তের হাতেখড়ি তাদের।

বিপত্নীক মাহে আলমের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে মারা গেছেন। ডোম হিসেবে আয়ের অঙ্কটা খুব মোটা অঙ্কের না। তবুও আক্ষেপ নেই তার। আল্লাহ ভালোই রেখেছেন এই তৃপ্তিতেই সন্তুষ্ট মাহে আলম।

আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা আর কাঠমোতে মাহে আলমদের বেঁচে থাকতে হয় কিছুটা যুদ্ধ করেই। পেশার কারণেই হয়তো সমাজ কিছুটা এড়িয়ে চলতে চায় এ পেশার মানুষদেরকে। তাদের সন্তান কিংবা পরিবারকে পোহাতে হয় নানান বিড়াম্বনা।

লাশ কাটার ঘরে প্রধান ডোমের সহযোগীর সাথে প্রতিবেদক



জানা যায়, অনেক বেওয়ারিশ লাশের কবর দেয়ার মতো অভিভাবক থাকেনা। অভিভাবকহীন লাশগুলোর অভিভাবকের অভাব বুঝতে দেন না মাহে আলম। নিজ দায়িত্বেই দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহের পরিবার থেকে খুশি হয়ে সামান্য বকশিশ দিলে নেন, নতুবা তার কোন আলাদা চাহিদা নেই।

মাহে আলমের জীবনেও রয়েছে অসংজ্ঞায়িত কিছু কাহিনী। বহু আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একসাথে করেছেন ২৮টি লাশের ময়নাতদন্ত। শত লাশের ভীড়ে কোন এক মহিলার লাশে ছুরি চালাতে হাত কাঁপে এই সাহসী ব্যক্তির। কারণ লাশটি যে অবিকল মাহে আলমের স্ত্রীর চেহারা! কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের চাকরির দাবিতে সেই লাশে ছুরি চালাতেই হলো তাকে। স্বপ্নে এখনো তাড়া করে বেড়ায় এই কাহিনী। তবে এসব ভয় থামিয়ে রাখতে পারেনি এই লাশঘরের তত্ত্বাবধায়ককে।

লাশ ঘরের সামনে রাখা কফিন

দশটা সাধারণ মানুষের মতোই মাহে আলমদের জীবন। অন্যদের মতো তারাও মানুষ। তাদের ভয়ের চোখে দেখার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘মাহে আলমের মতো মানুষরা আছে বলেই আমাদের মতো শিক্ষার্থীরা সহজভাবে সুশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারছি। সমাজের সবার উচিত এই পেশাকে সম্মানের চোখে দেখা এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া।’