ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উত্থান থ্রি ডক্টরসের তারিমের, আটক হয়েছিলেন আগেও
মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকার সদস্যরা। আজ শুক্রবার (১৮ আগস্ট) তাকে খুলনা নগরীর ওই কোচিং সেন্টার থেকে আটক করে ঢাকায় আনা হয়েছে।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ৭ চিকিৎসকসহ চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি। এর মধ্যে ওই কোচিংয়ের একজন ছিলেন। এছাড়াও ২০১৯ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস এবং ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্রে জালিয়াতি করার অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন ডা. ইউনুস খান তারিম।
ডা. তারিম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়াও তিনি খুলনা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
সূত্র জানায়, খুলনার এই কোচিং সেন্টার ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে ‘মেধাহীন’, ‘অযোগ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। এই ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে শতকোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।
ডা. তারিমের আটকের বিষয়ে খুলনা সদর থানার ওসি হাসান আল মামুন জানান, প্রশ্ন ফাঁসবিষয়ক একটি তদন্তে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ের একটি দল খুলনায় আসে। তারা ডা. তারিমকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। আটকের সময় খুলনা থানা পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়েছে কিনা তা জানা নেই।
ডা. তারিম নিজেই সবকিছু সামলাতেন, আমাদের সাথে খুব বেশি কিছু শেয়ার করতেন না। আমরা মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের সাথে আমাদের কোচিং সেন্টারের জড়িত থাকার বিষয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারবো না। তবে, ঢাকায় সিআইডির সংবাদ সম্মলেনের পর তারিম ভাই বলেছিলেন, আমাদের কোনো সমস্যা নাই, থ্রি ডক্টরস কোচিং এর সাথে জড়িত নয়—সহকারী ব্যবস্থাপক, থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টার।
ডা. তারিমের আটকের বিষয়ে আজ রাতে খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আকিব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, সকালে সিআইডি অভিযান পরিচালনা করে তাদের পরিচালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছেন। আজ শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় তিনি অফিসে যাননি। তার বাসা থেকে অফিস অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় তিনি এর বেশি কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। এছাড়াও কোচিং পরিচালনা এবং এ সংক্রান্ত সবকিছু ডা. তারিম নিজেই সামলাতেন। অন্যদের সাথে খুব বেশি শেয়ার করতেন না—তাই তিনি এ প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে তার প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানেন না।
তিনি সবকিছু নিজেই সামলাতেন, আমাদের সাথে খুব বেশি কিছু শেয়ার করতেন না। আমরা মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের সাথে আমাদের কোচিং সেন্টারের জড়িত থাকার বিষয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারবো না। তবে, ঢাকায় সিআইডির সংবাদ সম্মলেনের পর তারিম ভাই বলেছিলেন, আমাদের কোনো সমস্যা নাই, থ্রি ডক্টরস কোচিং এর সাথে জড়িত নয়—জানান থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক।
সম্প্রতি সিআইডি জানায়, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ৭ চিকিৎসকসহ চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপি ও ১ জন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানিলন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—ফেইম কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত ও প্রধান অভিযুক্ত ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সোহেলী জামান (৪০), প্রাইমেট কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. মো. আবু রায়হান, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টারের ডা. জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮), জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) এর চিকিৎসক ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭)।
এছাড়াও একই ঘটনায় সিআইডির হাতে আটক হয়েছেন ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), গ্রেপ্তারকৃত জসীমের বড় ভাই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), ই-হক কোচিং সেন্টারের মালিক আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩), ঢাকার ফার্মগেটে ইউনির্ভাসেল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্রের জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫), টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)।
এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বিগত ২০২০ সালের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূল হোতা জসীম উদ্দীন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান জসিমের খালাত ভাই মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তাদের দেওয়া ৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এই চক্রের ১২ জনের নাম আসে। দীর্ঘ দিন তারা পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড ডাক্তার ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান। তিনি ফাইন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। তিনি গত ১৭ বছরে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার স্ত্রী জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার সোহেলী জামানও এই চক্রের সদস্য।
এছাড়াও এ চক্রের অন্যতম সদস্য ডাক্তার আবু রায়হান, ডাক্তার জেডএম সালেহীন শোভন, ডা. জোবাইদুর রহমান জনি, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি, ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল। এছাড়া জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার, রওশন আলী হিমু, আক্তারুজ্জামান তুষার, জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার।
এ ঘটনায় নাম এসেছে মেডিকো ভর্তি কোচিং, ই-হক কোচিং সেন্টার, ফেইম কোচিং, প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টার, ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র এবং প্রাইমেট নামের একটি ভর্তি কোচিংয়ের নাম। সিআইডি জানিয়েছে, মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের আড়ালে নানা সময়ে এসব প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি।
সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক, প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।
এর আগে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।