শিক্ষার্থী পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ
চলতি বছর থেকে দেশের বেসরকারি মেডিকেল ভর্তিতে শুধুমাত্র ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির নিয়ম না রাখার কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এ নিয়ে এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নির্দেশনায় জানানো হয়, এখন থেকে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতি আসনের বিপরীতে মেরিট অনুযায়ী ৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সরকারের নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর অভাবে আসন খালি থাকা, এ খাত থেকে রাজস্ব হারানোসহ নানা আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)। বিপিএমসিএ বলছে, নতুন নীতিমালার শর্তে দেশে কমবে বিদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও।
তথ্যমতে, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে এবছর দেশে চলমান ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবেন বেসরকারি মেডিকেলেগুলোতে বিদ্যমান ৬ হাজার ৭৭২টি সিটের বিপরীতে মেধাতালিকায় থাকা তার পাঁচ গুণ অর্থাৎ ৩৩ হাজার ৮৬০ এর মধ্যে থাকা শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে, এ নিয়ে চূড়ান্ত নীতিমালাও প্রকাশ করেছে দেশের স্বাস্থ্যশিক্ষার অন্যতম তদারক সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।
বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতি আসনের বিপরীতে মেরিট অনুযায়ী ৫ জন শিক্ষার্থী এবং জিপিএ ৪.০০ নির্ধারণ করার ফলে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর অভাবে আসন খালি থাকবে, এ খাত থেকে রাজস্ব কমবে, বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসতে নিরুৎসাহিত হবে—বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)
সর্বশেষ প্রকাশিত নীতিমালায় বিএমডিসি বলছে, সরকারি মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তি (অপেক্ষমাণ তালিকা পর্যন্ত) সমাপ্ত হওয়ার পর বেসরকারি মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখে যেই সংখ্যক আসন অনুমোদিত থাকিবে উক্ত আসনের পাঁচ গুণ শিক্ষার্থীকে ভর্তির আবেদনের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হইবে।
বিএমডিসির এমন সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে বিপিএমসিএ বলছে, এ সিদ্ধান্ত প্রথমত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অবস্থান তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত, এতে মেধার অবমূল্যায়ন করা হবে। সংগঠনটি বলছে, এবছর উত্তীর্ণ ৩৯ হাজার ১৯৪ জনের মধ্যে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেসরকারি মেডিকেলের আসনের পাঁচগুণ অর্থাৎ ৩৩ হাজার ৮৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি সুযোগ পাবে। তাহলে, বাকী ৫ হাজার ৩৩৪ জন কি অপরাধ করেছে; তারাও তো পড়াশোনা করেই পাশ করেছে; তাদেরও ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিৎ। তাছাড়া এটি গতবছর ছিল না; এবছর ভর্তি প্রক্রিয়া চলার মাঝামাঝি সময়ে এমন সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে—যা উচিৎ হয়নি বলেও মত সংগঠনটির।
বিএমডিসির এবারের নীতিমালায় আরও জানিয়েছে, প্রার্থীকে এসএসসি বা ও’লেভেল বা সমমান পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হইতে হইবে এবং এইচএসসি বা এ লেভেল বা সমমান পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগসহ অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান থাকতে হবে। একইসাথে জীববিজ্ঞানে (Biology) ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ পয়েন্ট থাকতে হবে বলেও জানানো হয়েছে নীতিমালায়। যা অনুসরণ করা হবে দেশি এবং বিদেশি ভর্তিচ্ছুদের মেডিকেল ভর্তিতে।
চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছে বিএমডিসি; এখন আমরা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। এজন্য নতুন করে বিভিন্ন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে এবং বেসরকারি মেডিকেলে ভালো শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করতেই জিপিএ’এর শর্ত এবং মেরিট লিস্টের শুরু দিকের শিক্ষার্থীদের নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। দেশের চিকিৎসা শিক্ষার মান উন্নয়নে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল এবং তা করা হচ্ছে—বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)
তবে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হবে নম্বর সমতা-বিধান। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরের সমতা-বিধান করে তা চলমান জিপিএ ৪.০০ এর সমান হলে তা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, এবছরই জিপিএ ৪.০০ এর শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যা বিগত বছরগুলোতে ছিল ৩.৫। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসা শিক্ষায় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ৬০ শতাংশ এবং নেপালে ৭০ শতাংশ বা জিপিএ ৩ দশমিক ৫ এর সমান থাকতে হয়।
বিএমডিসির এ সিদ্ধান্তেও আপত্তি আছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ)। তারা বলছে, জীববিজ্ঞানে (Biology) ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ পয়েন্ট থাকার শর্তে বিদেশি শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হবে। ভারত এবং নেপালের উদাহরণ দিয়ে সংগঠনটির দাবি, সেখানে জিপিএ ৩.০০ পয়েন্ট থাকলেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাহলে, নতুন করে বেশি শর্ত বা যোগ্যতা নিয়ে কেন তারা বাংলাদেশে পড়তে আসবে; এছাড়াও, তার বেশি যোগ্যতা থাকলে তো সে সেখানকার মেডিকেলগুলোতেই পড়বে—বলেও অভিমত তাদের। বিপিএমসিএ’র দাবি এসব শর্তের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সহজ করতে হবে মেডিকেল ভর্তি প্রক্রিয়া একই সাথে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে শুনতে হবে অংশীজনদের মতামতও।
এ নিয়ে বেসরকারি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের (বারডেম) অধ্যক্ষ ডা. নাজমা হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থীর কোটা থাকলেও আমাদের এখানে তার ১০ শতাংশের মতো পূরণ হয় এবং তা পেতেও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে বেগ পেতে হয়। তিনি বলেন, আসন খালি থাকার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে—তা হতে পারে। এছাড়াও এবার ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম; পাশাপাশি, এবছর টিউশন ফিও বাড়ানো হয়েছে, এরও প্রভাব পড়তে পারে।
সরকার চিকিৎসা শিক্ষার মান উন্নয়নের যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে তাদের বিষয়টিও যৌক্তিক; আমাদের সব পক্ষের বিষয়গুলোই দেখা উচিৎ। এর আগে আমাদের কখনো আসন খালি ছিল না বা এরকম কোন পরিস্থিতি হয়নি। তবে, আমার আশঙ্কা এবার হয়তো হতে পারে—ডা. নাজমা হক, অধ্যক্ষ, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
বিগত ছয় বছর ধরে বেসরকারি চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুন্নু মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডা. আকতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে জানান, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য বিএমডিসি যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা নতুন করে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে; এটা বেশি সুবিধা-সম্পন্ন মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য খুব বেশি সমস্যা না হলেও কম সুবিধা সুবিধা-সম্পন্ন মেডিকেলগুলোর জন্য অনেক কষ্টদায়ক হবে। এছাড়াও জিপিএ’র শর্তসহ নতুন শর্তগুলো বাড়ানোর ফলে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে দেশি এবং বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে বলেও আশঙ্কা এই অধ্যক্ষের।
তিনি বলেন, বিএমডিসি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলছে; এটি তো শুধুমাত্র জিপিএ‘র উপর শর্ত দিলে হবে না; অন্যান্য বিষয়গুলো দেখতে হবে। ভালো শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধা, দক্ষ জনবল, ভালো প্রশাসন এবং প্রশাসক থাকতে হবে। মান বাড়ানো তো শুধু একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে না; সবগুলো বিষয়ের সমন্বয় করতে হবে—যুক্ত করেন ডা. আকতারুজ্জামান
এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করবে; যারা পাশ করেছে এবং মেধা তালিকায় এসেছে তাদের সবারই ভর্তি অধিকার রয়েছে। এ অদিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না; আমরা এ অধিকার বজায় রাখার দাবি জানিয়েছি—বিপিএমসিএ সভাপতি এম এ মুবিন খান
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমরা দাবি জানিয়েছি, এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা হয়েছে; তবে, এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই। তাদের সভার পর এ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলছেন, বিএমডিসি চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছে এবং আমরা এখন মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। এজন্য নতুন করে বিভিন্ন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে এবং বেসরকারি মেডিকেলে ভালো শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করতেই জিপিএ’এর শর্ত এবং মেরিট লিস্টের শুরু দিকের শিক্ষার্থীদের নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থী কমে যাওয়াসহ বিপিএমসিএ’র বিভিন্ন দাবির বিষয়ে ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলছেন, নীতিমালা সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান করবে এবং এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত বা সংশ্লিষ্ট না হলে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তারা যেসব দাবি করছে তা যৌক্তিক নয়; মেডিকেল শিক্ষার মান উন্নয়নে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল এবং তা করা হচ্ছে।