মাদ্রাসায় খেলার সময়ও লেখাপড়া!
কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয় দেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থীদের। ফলে তাদের বড় একটি অংশ খেলাধুলাসহ সব ধরনের বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠে। নিজের জীবনের এমন সেই স্মৃতি জানান রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করা মুহিব নেছার। বাংলায় স্নাতকোত্তর এই শিক্ষকের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে ছারছিনা দরবারের আলিয়া মাদ্রাসায়।
তিনি বলেন, মাদ্রাসায় আমাদের অবসর সময় ছিল শুধু আসরের নামাজের পর ঘন্টাখানেক। তাও মাদ্রাসার গণ্ডির ভেতরেই থাকতে হতো। ফুটবল-ক্রিকেট এ ধরনের খেলার কোনো সুযোগ ছিল না৷ হাঁটাহাঁটি বা একটু দৌড়াদৌড়ি এই ছিল আমাদের খেলা। আমাদের বাজারে যাওয়ার অনুমতি ছিল সপ্তাহে শুধু এক দিন।
গত কয়েক দশকে দেশের শিক্ষার পাঠক্রম আর পরীক্ষার চাপে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয় খুদে শিক্ষার্থীদের। আর শহরে সেটা আরো ঘরবন্দি শিশুদের জীবন। তবে দেশের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ খেলাধুলাসহ সব ধরনের বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠে ঐতিহ্যগত কারণেই। কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয় বেশিরভাগ মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থীদের।
তবে সবদিক দিয়ে এসব থেকে তুলনামূলক মুক্ত সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা আলিয়া মাদ্রাসার পরিবেশ। সেখানে পাঠ্যক্রম অনেকটা স্কুল-কলেজের মতো। খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আর সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসায় আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। পুরনো দিনের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করছে তারা।
এমনটাই জানালেন বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসায় শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। জাগতিক বিষয়গুলো সেখানে গৌণ। শরিয়তের কারণে কিছু বিষয়, যেমন টিভি দেখার মতো বিনোদনমূলক বিষয়গুলো সেখানে নিষেধ। খেলাধুলার ক্ষেত্রেও তারা নিরুৎসাহিত থাকে। এই কারণে কওমির ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুমের সময় বাদ দিয়ে, বাকি সময় লেখাপড়ার মধ্যে থাকে।
সরকারের বাইরে থাকা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাদের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, দেশে মোট কওমি মাদ্রাসা সংখ্যা ১৩ হাজার ৭১০। এর মধ্যে পুরুষদের জন্য ৯ হাজার ১০৮টি, আর নারীদের ৪ হাজার ৬০২টি। গত বছর তাদের পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৬১ হাজার ৬৩১ জন। বেফাকের বাইরেও আরো কওমি মাদ্রাসা আছে।
অন্যদিকে, সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। দুই ধারা মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি বলে সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যানে জানা যায়৷ এই তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দেশের শিশুদের বড় একটা অংশ বিনোদনের কোনো খোরাক না পেয়েই বড় হচ্ছে।
তবে কওমিতে না থাকলেও আলিয়া মাদ্রাসায় সৃজনশীল চর্চার অনেক দিক আছে। তাই এই ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্য বিষয় জানার সুযোগ বেশি রয়েছে বলে মনে করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরচিালক আনোয়ার কবীর। তিনি বলেন, ‘কওমি ধারায় সৃজনশীল চর্চার সুযোগ অনেক কম। কারণ, তারা নিজেরাই সিলেবাস নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷ তবে কর্তৃত্ব নয়, সহযোগিতার মানসিকতা দেখাতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে কওমি পক্ষকেও।’
কওমি শিক্ষাধারাকে মূলধারার সমান্তরাল করতে সরকারি কিছু উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। বেফাক নেতাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বছর তিনেক আগে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের দাওরায়ে হাদিস পেয়েছে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তরের সমমান। একে তখন যুগান্তকারী ঘোষণা হিসেবে দেখেছেন অনেকে।
তবে কওমি-পড়ুয়া শিশুদের গোঁড়ামিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে তৃণমূল পর্যায়ে সৃজনশীল চর্চা প্রসারিত করতে হবে বলে মনে করেন সাংবাদিক ও লেখক আনোয়ার কবীর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার শিশুরা রাষ্ট্রের একটি বড় অংশ। এদেরকে গোঁড়ামি বা কুসংস্কার মুক্ত করতে হলে সৃজনশীল বইপত্র দেয়া প্রয়োজন। এজন্য সরকারের পাশাপাশি কওমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে সময়ের পরিবর্তনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। তাদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। গতবছর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মুভ ফাউন্ডেশনের এক জরিপমতে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে। তাদের প্রায় সবার আছে স্মার্টফোন।
এ বিষয়ে আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বলেন, মাদ্রাসায় যারা আবাসিক থাকে, সেই ছাত্রছাত্রীদের বয়স ২০-এর নীচে হলে তাদের সাধারণত স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। অনাবাসিক যারা বা যারা মাদ্রাসার গণ্ডি পার হয়ে গেছেন, কিংবা বয়স ১৮ পার হয়েছে, তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। তারা স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে বাংলা