আল্লামা শফীর ৩১ বছরের পরিচালক পদ কেন চ্যালেঞ্জের মুখে?
চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফীর ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জ এসেছে তারই অনুসারী জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষ থেকে। তার ছেলে আনাস মাদানী অভিযোগ করেছেন, গত দু’দিনে বাবুনগরীর সমর্থক ছাত্ররা এবং কিছু বহিরাগত বিক্ষোভ করে মাদ্রাসাটির দখল নিয়েছিল।
অবশ্য বাবুনগরীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা আহমদ শফীকে মাদ্রাসার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে অব্যাহতি দেয়াসহ ছয় দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিলি করে। বিক্ষোভ থেকে আহমদ শফী এবং তার সমর্থক শিক্ষকদের কক্ষে ভাঙচুর এবং একজনকে মারধরের ঘটনাও ঘটে। খবর: বিবিসি বাংলা।
বিক্ষোভের মুখে আহমেদ শফীকে হাজির করে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক করা হয় এবং সেই বৈঠকের পর আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার শিক্ষকের পদ থেকে অব্যাহতিও দেয়ার কথা জানানো হয়। শেষপর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেয়।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ১২৪ বছরের পুরোনো এই মাদ্রাসার নাম হচ্ছে, জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম। আহমেদ শফী এই মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল এবং একইসাথে পরিচালকের দায়িত্ব পান ১৯৮৯ সালে। এর আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। মাদ্রাসাটির একজন সাবেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর আগে তাকে অসম্মান করে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, আহমদ শফী যখন প্রধানের দায়িত্ব পালন শুরু করেন, তখন মাদ্রাসার বেশিরভাগ শিক্ষকই তার ছাত্র ছিলেন। ফলে তারা তার কোন সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড কখনও চ্যালেঞ্জ করতেন না।এছাড়া ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার ছেলে আনাস মাদানী মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান।
সাবেক ওই শিক্ষক আরও জানিয়েছেন, একদিকে বেশিরভাগ শিক্ষকের পক্ষ থেকে কোন চ্যালেঞ্জ ছিল না, অন্যদিকে ৯০-এর দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসার প্রধান হিসাবে আহমদ শফীর একটা গুরুত্ব এবং ভাবমূর্তি তৈরি হয়। এ সবের সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতির কারণে মাদ্রাসাটিতে তিনি এবং তার ছেলে মাদানীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, মাদ্রাসা পরিচালনার যে কমিটি রয়েছে, যাকে শূরা বলা হয়, ২০০০ সাল থেকে ১৬ বছর সেই কমিটির কোন বৈঠক করা হয়নি। একক নেতৃত্বে ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগ ও অপসারণসহ সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে কারণে কর্তৃত্ব বা মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল দীর্ঘ সময় ধরে। এখন তারই প্রকাশ ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
তবে মাদানী একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, মাদ্রাসার কোন কাজ একক সিদ্ধান্তে হয়নি এবং কোন ক্ষেত্রে অনিয়ম নেই। তিনি দাবি করেছেন, মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে স্বচ্ছতার সাথে সব কাজ হয়েছে। তিনি এখনকার ঘটনার পিছনে রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
আল্লামা শফীর ছেলে আউট, বাবুনগরী ইন?
তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে একটা অপশক্তি মাদ্রাসা দখল করার জন্য হামলা করেছিল এবং তখন একজন নিহতও হয়েছিল। সেই ঘটনায় তখনকার মুরব্বীরা সামাল দিয়েছিলেন। সেই পরাজিত শক্তি এখন আবার অনেকদিন ধরে হাটহাজারীর মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে দখল নেয়ার পরিকল্পনা করছিল। তারাই মাদ্রাসার একজন শিক্ষকের সমর্থনে বহিরাগতদের নিয়ে সহিংসতা চালিয়েছে।
মাদানী রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘যখন আলেম ওলামাদের সাথে সরকারের একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তখন তা নস্যাৎ করার জন্য দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য আন্দোলনের নামে মাদ্রাসায় ভাঙচুর এবং অনেক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।’
তিনি অভিযোগ করেছেন, বিক্ষোভে তার বহিষ্কারের দাবি করা হলেও এর মূল টার্গেট মাদ্রাসাটির পরিবেশ নষ্ট করা। তার একজন সমর্থক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কিছু ছাত্রকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে এবং মাদ্রাসায় আন্দোলনের পিছনে কোন উগ্রগোষ্ঠী এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের মদত রয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
মাদ্রাসাটির একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, আহমদ শফীর বয়স একশ’র বেশি হয়েছে। বয়সের ভারে তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে কোন কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেন না। ফলে তার উত্তরসূরি কে হবেন- এই প্রশ্নে অনেকদিন ধরেই মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে নানা আলোচনা ছিল।
তিনি জানিয়েছেন, মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জুনায়েদ বাবুনগরীকে ২০১১ সালে সহকারী পরিচালক করা হয়েছিল। তিনিই উত্তরসূরি হতে পারেন-এমন একটা আলোচনা ছিল। কারণ তাকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিবও করা হয়েছিল।
অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনও নির্দেশনা নেই: গণশিক্ষা সচিব
কিন্তু ওই সিনিয়র শিক্ষক মনে করেন, আনাস মাদানীর পরামর্শে আহমদ শফী মাদ্রাসার সাবেক একজন শিক্ষক শেখ আহমদকে আবার ফিরিয়ে আনেন। তখন এটা স্পষ্ট হয় যে বাবুনগরীকে ঠেকানোর জন্য তাকে আনা হয়েছে। এনিয়ে বাবুনগরী এবং তার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল।
গত এপ্রিল মাসে বাবুনগরীকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে শেখ আহমদকে সেই পদে বসানো হয়। সে সময়ও মাদ্রাসায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তা তখন প্রকাশ হয়নি।পরে রমজানের মধ্যেও একই ইস্যুতে উত্তেজনা দেখা দিলে তখন দুই পক্ষ আলোচনার পর মাদানী এবং বাবুনগরী ছাত্রদের সামনে একসাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
কিন্তু এখন দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয় ব্যাপকভাবে। যদিও বাবুনগরীর সমর্থক হিসাবে পরিচিত মাদ্রাসাটির একজন শিক্ষক আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেছেন, ছাত্রদের বিক্ষোভের সাথে বাবুনগরী বা তাদের কোন সম্পর্ক নেই। ভর্তিসহ নানা ক্ষেত্রে হয়রানির জন্য মাদানীর প্রতি ক্ষোভ থেকে ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
তবে মাদানী এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, উগ্র কোন গোষ্ঠী এবং বাইরের মদতে তার বাবার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা হচ্ছে এবং বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মাদ্রাসাটির পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ডের কারণে রাজনীতিও একটা বিষয় হয়েছে দ্বন্দ্বের পিছনে। তিনি আরও বলেছেন, ২০০৯ সালে হেফাজতে ইসলাম যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পর্যায়ে। ২০১৩ সালে বিভিন্ন দাবি নিয়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হলো।
এরপর হেফাজতে ইসলাম এবং আহমদ শফী এবং আনাস মাদানীর সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়। সেই প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড নিয়েও শফীর সাথে জুনায়েদ বাবুনগরী এবং তার সমর্থকদের দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে। পরিচালনা কমিটির ওই সদস্য মনে করেন, বাবুনগরী সরকার বিরোধী অবস্থানের হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
আহমদ শফীর সমর্থকদের পক্ষ থেকে বাবুনগরীর বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ত রাখার অভিযোগ করা হয়। যদিও তিনি তা বিভিন্ন সময় অস্বীকার করেছেন। তবে মাদ্রাসার একজন সাবেক শিক্ষক মনে করেন, মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সাথে বাইরের রাজনীতি এবং ব্যক্তিস্বার্থের কারণেও সেখানে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে এবং এখন পরিস্থিতি অস্থির হয়েছে।
একাডেমিক দিক থেকে এর গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, দুই দশক ধরে বিভিন্ন সরকার বা বড় রাজনৈতিক দলগুলোও হাটহাজারীর এই মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে এর একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক সময় দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে লংমার্চ এবং ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল।
সংগঠনটি তখন কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবি তুলেছিল। সেই হেফাজতে ইসলামের আমীর হচ্ছেন আহমদ শফী এবং মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। ২০১৩ সালের ৫ মে অবরোধ কর্মসূচি থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, হাটহাজারীর মাদ্রাসাটি যেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
তবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্ব- সবমিলিয়ে মাদ্রাসাটির নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব অনেক বছর ধরে রয়েছে। তবে এই মাদ্রাসায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হওয়ায় বড় কোন ঘটনা না ঘটলে তা প্রকাশ হয়নি বা সংবাদমাধ্যমে আসেনি।