১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:৪৯

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগ: ক্ষমতা পাচ্ছেন ডিসি-ইউএনওরা

সারাদেশে মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগ কমিটিতে প্রতিনিধি রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে মাদ্রাসা অধিদপ্তর। মাদ্রাসার শীর্ষ পদে নিয়োগ বোর্ডে এত দিন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি রাখা হতো। এই সুযোগ নিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্যদের নিয়োগের সুপারিশ করতেন। এ নিয়ে একাধিক যোগ্য প্রার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এখন থেকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে অধিদপ্তরকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাসার শীর্ষ পদ দুটিতে নিয়োগ দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ একটি গ্রুপ নানা ধরনের বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মাদ্রাসা অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট। অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ পাইয়ে দিতে স্থানীয় ও অধিদপ্তরের একটি বলয় তৈরি করে। কখনো স্থানীয় বিষয়াদি না জেনেই হঠাৎ করে একজন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দেন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি। এছাড়া মাদ্রাসা অধিদপ্তরের শিক্ষা ক্যাডারের একজন উপ-পরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালক মিলে সব নিয়োগ কমিটি যান। সারাদেশ থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর উপ-পরিচালককে বদলি করলেও অদৃশ্য কারণে এখনো রয়েছেন অধিদপ্তরে। নানা চেষ্টায় এ বলয় ভাঙাতে না পেরে ডিসি-ইউএনওদের মাধ্যমে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগ।

বিষয়টি স্বীকার করে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মুনসী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, 'জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মাদ্রাসা অধিপ্তরের কর্মকর্তা নাই বললেই চলে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন দিয়ে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও সুপার, ভাইস প্রিন্সিপাল নিয়োগ কমিটিতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা থাকবে। জেলা পর্যায়ে ডিসির এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি থাকবে। এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা কমার পাশাপাশি আরও স্বচ্ছতা আসবে বলে আমরা মনে করেছি। তাই অধিদপ্তরকে এ নির্দেশনা দিয়েছি।' অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়োগ সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অধিদপ্তরের কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে বলেই আমরা স্বচ্ছতা চাচ্ছি।'

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাসা অধিদপ্তরের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে নিয়োগ ব্যাণিজের অভিযোগ করে গত ১৫ জানুয়ারি মাদ্রাসা অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন মো. মজিবুর রহমান। তিনি অভিযোগে বলেছেন, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার মহিষকাটা নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার নিয়োগে প্রথম স্থান অধিকার করলে নিয়োগ বোর্ড তাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু মাদ্রাসা অধিদপ্তরের ডিজির প্রতিনিধি উপ-পরিচালক (অর্থ) মো. শামছুজ্জামান তিন লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে তার নিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে তাকে মামলায় জড়িয়ে দিন। এতে তিনি আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। অভিযোগে বলা হয়েছে, দুর্নীতিবাজ উপ-পরিচালকের কারণে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১৪ জানুয়ারি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার বাগাট দাখিল মাদ্রাসার সহসুপার পদে নিয়োগবঞ্চিত হয়ে অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছেন মোহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম। তিনি অভিযোগে বলেছেন, গত বছরের ২৭ জুলাই উক্ত মাদ্রাসার সহসুপার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গত ১১ জানুয়ারি নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নিয়োগ বোর্ড অন্যায়ভাবে তাকে লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্যের কম নম্বর দেয় এবং সার্টিফিকেটের প্রাপ্ত নির্ধারিত নম্বর কম দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখিত আবেদন করলেও কোন প্রতিকার পাননি। কিন্তু ডিজির প্রতিনিধি উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শামসুজ্জামান পুনর্মূল্যায়ন না করে উল্টো তাকে ভয়ভীতি দেখান।

কুমিলস্নার বরুড়া উপজেলার ঝাপুয়া আশরাফিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার পদে নিয়োগের জন্য প্রথম হয়েও নিয়োগবঞ্চিত করা হয়েছে মো. ফজলুল হককে। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, তিনি দ্বিতীয় বার অংশ গ্রহণ করে প্রথম হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ ফলাফল ঘোষণা করে তাকে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করে। তবে নিয়োগ কমিটি ব্যাণিজ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তাকে নিয়োগে টালবাহানা করে। এরপর নিয়োগের জন্য বিভাগীয় সকল দপ্তরে তিনি আবেদন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও মাদ্রাসা অধিদপ্তরে আবেদন করেন। কিন্তু অধিপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামছুজ্জামান প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। একই সঙ্গে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের অনুমতি দেন। প্রতিকার চাইলে মো. ফজলুল হকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। উপ-পরিচালক তৎকালীন পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ড. সরোয়ার আলমকে খেপিয়ে তুলেন। পরিচালক ও উপ-পরিচালক মিলে মো. ফজলুল হককে দপ্তরে ডেকে নিয়ে নাজেহাল করেন। এরপর মো. ফজলুল হক প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলা করলে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং চাকরি হলেও এমপিওভুক্ত করা হবে না বলে হুমকি দেন।

অভিযোগ রয়েছে, এভাবে সারাদেশে মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদ তথা সহসুপার, সুপার, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে অধিদপ্তরের ডিজির প্রতিনিধিরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে যোগ্যপ্রার্থীকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিচ্ছেন। এতে করে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে দক্ষ শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হলেও প্রশাসনিক পদে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ সদস্যের নিয়োগ বোর্ডে ডিজির একজন প্রতিনিধি থাকে। তিনিই নিয়োগের কলকাঠি নাড়েন। (সূত্র: দৈনিক যায়যায়দিন, প্রতিবেদক: নূর মোহাম্মদ)