২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৭

আলিয়া মাদ্রাসার আরবির শিক্ষকরা আরবি পড়াতে চান না, কারণ কী

রাজধানীর একটি মাদ্রাসার শ্রেণিকক্ষ   © সংগৃহীত

দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) একটি বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পরে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তরও সম্পন্ন করেন। একই সময়ে তিনি রাজশাহী একটি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও কামিল সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে ফাজিল ও কামিলের সনদ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গাইবান্ধার একটি মাদ্রাসায় আরবি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে আরবি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেও আরবি বিষয়ে পড়াতে আগ্রহী নন তিনি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, আরবি ভাষায় প্রতি তার আয়ত্ত কম। তার এক সহকর্মী জানান, ইবারত (হরকত ছাড়া) ঠিকঠাক পড়তে পারেন না তিনি। এ কারণে আরবি প্রভাষক হয়েও অন্য বিষয় কিংবা জেনারেল বিষয় পড়াতে আগ্রহী তিনি।

জহিরুল হক নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এক শিক্ষার্থী কলা অনুষদের অধীন একটি বিভাগে ভর্তি হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গ্রামের একটি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও কামিল সম্পন্ন করেন। তিনি জানান, মাদ্রাসায় ক্লাস করতে হয় না। শুধু ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেন। শুধু রফিকুল ইসলাম ও জহিরুল হক নন, একই সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পড়াশোনার পাশাপাশি ফাজিল ও কামিলেও অধ্যয়ন করেন দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, ত্রুটিপূর্ণ এনটিআরসিএর নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং ফাজিল ও কামিল থেকে নামমাত্র পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট অর্জনের পর চাকরির বাজারে নিজেদের মেলে ধরেন। ফলে অদক্ষ শিক্ষক পাচ্ছে দেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলো। দেশের নামী হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদে বেশির ভাগ মাদ্রাসার চিত্র একই।

‘‘আলিম পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মাদ্রাসায় ভর্তি থাকলেও ক্লাস করে না, শুধু পরীক্ষা দেয়। এখানেও পরীক্ষা পদ্ধতির কিছুটা ত্রুটি আছে। তারা ফাজিল ও কামিল পাস হলেও তারা ভালো সিজিপিএ পায়। কিন্তু তাদের দক্ষতা হয় না, কারণ তারা সেখানে ক্লাস করে না। তারা ক্লাস না করে কীভাবে পাস করে? নিশ্চয় পরীক্ষার কিছু ত্রুটি আছে। পরীক্ষা প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষাটা এমনভাবে নেওয়া হয়, ক্লাস না করেও পাস করা যায়। তাই তাদের ক্লাস করতে বাধ্যতামূলক করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখতে হবে-অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, চেয়ারম্যান, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জানা গেছে, মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) পাস করার পর প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক করতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও কামিলের সার্টিফিকেট অর্জন করতে নামমাত্র পড়াশোনা করে থাকেন। এদিকে আলিয়া মাদ্রাসায় এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় তারা সব সময় এগিয়ে থাকেন এবং নিয়োগ পেয়ে থাকেন । পরবর্তী সময়ে আরবি, ইসলামিক বিষয়ে কম জানার কারণে জেনারেল বিষয়ে পড়াতে আগ্রহী হন তারা।

আরও পড়ুন: মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে ফিরছে হিজাব-টুপি, বাদ যাবে ‘মোনালিসা’, যুক্ত হবে ‘খাদিজা’

দেশে দাখিল-আলিম পর্যায়ের মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। দাখিল ও আলিম চালু আছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৪৭৪ ও ১ হাজার ৫২৫টিতে। ফাজিল মাদ্রাসা ১ হাজার ৩৪৭টি। কামিল মাদ্রাসা ৩৫৯টি। আর সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ৩টি। তবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আলিম পরীক্ষা দিয়ে পাস শিক্ষার্থীর তালিকা থেকে জানা গেছে, প্রতিবছরই ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হচ্ছেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন ৭৯ হাজার ৯০৯ জন। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। পাশাপাশি মাদ্রাসা থেকেও ফাজিল (ডিগ্রি) ও কামিলে পড়াশোনা করছেন। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই স্নাতকের পাশাপাশি ফাজিল-কামিলে পড়ছেন বলে জানান তারা।

তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার প্রভাষক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘রাজধানী, বিভাগীয় শহরের কয়েকটি বাদে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলের মাদ্রাসাগুলোয় পাওয়া আরবি, হাদিস বা ইসলামিক বিষয় নিয়োগ পেয়েও তারা ভিন্ন বিষয় পড়াতে আগ্রহী। কারণ সে বিষয়ে তারা জানেন না বা পারেন না।

৪০তম বিসিএস ক্যাডার ও সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার প্রভাষক আলী হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শুধু মাদ্রাসা থেকে ফাজিল-কামিল পাস করেছেন, তাদের আরবি, হাদিস, ফিকহ বা ইসলামিক বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু জেনারেল বিষয়ে কম জানার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে তারা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্যদিকে মাদ্রাসা ও অনার্স-মাস্টার্স একসঙ্গে যারা পাস করছেন, তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেনারেল বিষয়ে ভালো করছেন এবং শিক্ষক হিসেবে যোগদান করছেন। যে বিষয়ে তিনি মাদ্রাসায় নিয়োগ পাচ্ছেন, সে বিষয়ে তিনি ভালো পড়াতে পারছেন না বা আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে সরকার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, এটি বাস্তবায়ন হলে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক পাবে বলে মনে করছি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের জন্য জেলা, বিভাগীয় শহরে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সারা দেশের মাদ্রাসার জন্য একটিমাত্র ট্রেনিং সেন্টার। এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। এতে ট্রেনিংয়ের সংখ্যা বাড়বে ও শিক্ষকরা ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠবে।’

আরও পড়ুন: মাদ্রাসার দাখিল-আলিমে সহসাই চালু হচ্ছে না ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এনটিআরসিএর আগের পদ্ধতিতে নেওয়া নিয়োগের মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো দুর্বল শিক্ষক পেত। নতুন শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি (মাদ্রাসার সহকারী মৌলভি ও প্রভাষক পদের জন্য ২০০ নম্বরের ভিত্তিতে ১৪০ নম্বর বিষয়ভিত্তিক এবং বাকি ৬০ নম্বর জেনারেল বিষয়) চালু হচ্ছে এবং দক্ষ শিক্ষক পাবে মাদ্রাসাগুলো। ইতোমধ্যে নতুন পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

‘এত দিন যে পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ হতো, তাতে মাদ্রাসাগুলোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যেত না। কারণ প্রিলিমানারি পরীক্ষা সবার জন্য সমান ছিল, এতে আরবিতে ভালো যারা, তারা সেখান থেকে বাদ পড়ে যেত। আবার লিখিত বিষয়ে আরবি বিষয়গুলো জন্য নম্বর কম ছিল, কম থাকার কারণে সাধারণ বিষয়ে যারা ভালো করত, তারা পাস করত ও নিয়োগ পেত। এতে দুর্বলরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেত। বর্তমানে যে পদ্ধতি চালু হচ্ছে এবং আরবি বিষয়ে নম্বর বাড়ানো হয়েছে, আশা করছি বা ধারণা করছি, আগের তুলনায় দক্ষ শিক্ষক পাবে মাদ্রাসাগুলো।’

তিনি বলেন, আলিম পাসের পর মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীরা অনার্স করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে পাশাপাশি ফাজিল ও কামিলেও পড়াশোনা করছে। যেকোনো এক জায়গায় থেকে পড়াশোনা করা উচিত। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা এ রকম হয়ে গেছে। তা ছাড়া চাকরির বাজারে নিজেদের মেলে ধরতে দুই জায়গায় থাকছে।

ড. যুবাইর বলেন, ‘আলিম পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মাদ্রাসায় ভর্তি থাকলেও ক্লাস করে না, শুধু পরীক্ষা দেয়। এখানেও পরীক্ষা পদ্ধতির কিছুটা ত্রুটি আছে। তারা ফাজিল ও কামিল পাস হলেও তারা ভালো সিজিপিএ পায়। কিন্তু তাদের দক্ষতা হয় না, কারণ তারা সেখানে ক্লাস করে না। তারা ক্লাস না করে কীভাবে পাস করে? নিশ্চয় পরীক্ষার কিছু ত্রুটি আছে। পরীক্ষা প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষাটা এমনভাবে নেওয়া হয়, ক্লাস না করেও পাস করা যায়। তাই তাদের ক্লাস করতে বাধ্যতামূলক করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখতে হবে। মেধা মূল্যায়নের জন্য একটি সঠিক ও উপযুক্ত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রশ্ন কমন পড়া পদ্ধতি, অর্থা চার-পাঁচ বছরের প্রশ্ন যাচায়-বাছাই করে পড়লে প্রশ্ন কমন পড়ে যাচ্ছে এবং তারা পাস করে যাচ্ছে। এ কারণে ক্লাস না করলেও তারা পাস করে ফেলছে। সবমিলিয়ে অধিকাংশ চাকরি প্রার্থী এমন হলে তো সবল প্রার্থী পাওয়া যাবে না। তাই এনটিআরসিএ পরীক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি মাদ্রাসার পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। যে কারণে ভালো ক্যান্ডিডেট পাওয়া যাচ্ছে না।’