২১ ঈদ ধরে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এক নীরব পাহারাদার বেলাল হোসেন
২১ বছর ধরে একই গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের দিনে শিক্ষার্থীশূন্য নিস্তব্ধ ক্যাম্পাস পাহারা দেন তিনি। একটানা দশটি কোরবানির ঈদ কাটিয়েছেন পরিবারের বাইরে। গায়ে থাকে ডিউটির ইউনিফর্ম, মুখে থাকে দায়িত্ববোধের চাপা হাসি। তিনি বেলাল হোসেন, বয়স ষাট, পেশায় পাহারাদার। তা'মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা। এই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণই তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। কখনো আনন্দে, কখনো বিষণ্নতায়, কিন্তু বরাবর একাগ্রতায় তিনি রয়ে গেছেন এখানেই।
বেলাল হোসেন বলেন, “২০২৩ সালের ঈদসহ আমি দশবার কোরবানির ঈদ করেছি ক্যাম্পাসে। ঈদের নামাজের সময়টুকু বাদ দিলে পুরো সময় গেইটেই থাকতে হয়। সবাই যখন নতুন জামা পরে, আমরা তখন ইউনিফর্মে। কারণ আমাদের ডিউটি থাকে।”
তার কণ্ঠে আক্ষেপ নেই, আছে অভ্যস্ত এক নির্লিপ্তি। তিনি বলেন, “পরিবার ছাড়া নতুন পোশাকে ঈদ করতে ভালো লাগে না। তাই কখনো নতুন জামা পরিনি এখানে। তবে বাড়িতে গেলে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঈদের পোশাক পরেই করি আনন্দ।”
মাদ্রাসা ছুটিতে থাকলে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। বেলালের কণ্ঠে ঝরে পড়ে সেই একাকিত্বের করুণ সুর—“ছাত্ররা থাকলে মনে হয় বাড়িতে থাকার প্রয়োজন নেই। ওরা-ই আমার পরিবার। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আনাগোনায় মনটা ভালো থাকে। কিন্তু ছুটি হলে পুরো জায়গাটা নীরব হয়ে যায়। তখন খুব মন খারাপ হয়। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে।”
এই বছর ঈদেও সাতজন নৈশপ্রহরীর মধ্যে তিনজন ছুটিতে থাকবেন তারা হলো রেজাউল করিম , নিজাম উদ্দিন আর বেলাল হোসেন নিজেই। তবে এবারও দায়িত্বে থাকতে হবে অন্য চারজনকে ক্যাম্পাস পাহারায় তারা হলো ইউনুস, ইমদাদুল হক, আব্দুল কাদের ও শফিক।
বেলাল হোসেন বলেন, ‘ঈদের দিনে যখন শহরের প্রতিটি ঘরে ভরপুর রান্না, অতিথি, উষ্ণতা। তখন এই ক্যাম্পাসে আমরা চারজন পাহারাদার একসাথে খাওয়ার আয়োজন করেছিলাম নিজেদের মতো করে ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার দিন । তবে এই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণের আশপাশে অনেক শিক্ষকের বাসা, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরাও আছেন। কিন্তু ঈদের দিনে আমাদের জন্য একটা আটা রুটি একটুকরো রান্না মাংস কারো বাসা থেকে আসেনি।বেলাল হোসেন বলেন ২০২৩ সালের কুরবানীর ঈদের দিন আটা রুটি অনেক অনুভব করেছি তবে কোথাও থেকে আসেনি।’
তিনি জানান স্মৃতিতে আজও জীবন্ত হয়ে আছে সাবেক উপাধ্যক্ষ শফিকুল্লাহ মাদানী।“তিনি রোজার ঈদে আমাদের সেমাই খাওয়াতেন, কোরবানির ঈদে নিজের বাসায় নিয়ে যেতেন আটা রুটি আর গরুর মাংস দিয়ে খাওয়াতে। সেই সময়টা ভুলতে পারি না। উনি এখন আট বছর ধরে অবসরে।
বেলাল হোসেন বলেন ২০২৩ সালের ঈদের দিন আমরা নিজেরাই খাবার রান্না করেছি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কিছু মাংস ও বাজার আগে থেকেই দিয়ে রেখেছিলেন।
এই দায়িত্বশীল মানুষটি নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় দিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তায়। এক ছেলেকে অনার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন। বড় ছেলে গার্মেন্টসে সুপারভাইজার, ছোট মেয়ে বিবাহিত। তবুও তিনি এই গেইটটিকে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি ভাবেন। তিনি বলেন “জীবনের যা বাকি সময় আছে , সুস্থ থাকলে এখানেই কাটানোর ইচ্ছে আছে বলেন বেলাল।
প্রশ্ন উঠে আসে—এমন কত শত বেলাল হোসেন আছেন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি-আধা সরকারি অফিসে, যারা ঈদের দিনে দায়িত্ব পালন করে যান নীরবে, নিঃশব্দে? তাদের জন্য কি একটুকরো মমতা রাখা যায় না? অন্তত এক চামচ গরুর মাংস, একটুকরো রুটি, একবার ‘ঈদ মোবারক’ বলা?
ঈদ মানে তো সবার জন্য আনন্দ। শুধু শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অভিভাবকদের জন্য নয়। ঈদ তো তাঁদের জন্যও, যাঁদের অবিরাম সেবায় নিরাপদ থাকে প্রাঙ্গণ, প্রতিষ্ঠান, প্রিয় ঠিকানা।