বেতন-ভাতা ছাড়াই পাঁচ মাস, মানবেতর জীবন দারুল আরকামের শিক্ষকদের
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় পরিচালিত দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রকল্পে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অফিস সহায়কদের পাঁচ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। চলমান সংকট নিরসনে ও ঈদুল আজহার পূর্বে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে রবিবার (২৫ মে) দেশের সকল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছে ‘বাংলাদেশ দারুল আরকাম শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’।
সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক হাজার দশটি মাদ্রাসা নিয়ে গঠিত প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুমোদন দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছে। এর ফলে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত (মে পর্যন্ত) পাঁচ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না প্রকল্পভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।
শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, ঈদুল ফিতরের সময়ও পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি তারা। আসন্ন ঈদুল আজহার পূর্বেও যদি বেতন-ভাতা পরিশোধ না হয়, তাহলে তাদের পরিবার, বিশেষ করে শিশু সন্তানরা ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
আরও পড়ুন: শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে
শিক্ষকরা জানান, ২০২০ সালেও একই প্রকল্পে অনুমোদন বিলম্ব হওয়ায় তারা এক বছর পর্যন্ত বেতন-ভাতা পাননি। তারা কর্মরত থাকা অবস্থায় কেন এভাবে দীর্ঘদিন বেতন বন্ধ থাকে, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা বা দায়িত্বশীল মন্তব্য মেলে না। অথচ করোনা মহামারির সময় এই প্রকল্পের শিক্ষকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের সেবা, মরদেহ দাফন, বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও ট্রাফিক সেবায় অংশ নিয়েছেন।
জানা গেছে, চলতি বছর প্রকল্পের অনলাইন জনমত যাচাইয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মতামতের রেকর্ড তৈরি হয়েছে, যা প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে।
সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের আর্থিক বাজেটের অনুমোদন থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনবল সংক্রান্ত সভা না হওয়ায় প্রিএকনেক (পূর্ববর্তী প্রশাসনিক অনুমোদন) আটকে আছে। ফলে বেতন-ভাতা প্রদানের প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষক ও কর্মীরা বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেখানে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন, সেখানে আমাদের বেতন বন্ধ — এটা চরম বৈষম্য। মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত প্রকল্প অনুমোদন ও বেতন পরিশোধ করা হোক।
আরও পড়ুন: জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো ৪ যুবকের বিষপান, হাসপাতালে ভর্তি
জানা যায়, ‘দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা’ শীর্ষক প্রকল্পটি একনেক সভায় ২০২২ সালের ১ জুন অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৯০৯ কোটি ৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের সকল উপজেলায় অবকাঠামোগত ব্যয় ছাড়াই ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এখানে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়। পাশাপাশি ২ হাজার ২০ জন শিক্ষক ও ১ হাজার ১০ জন সহায়ক কর্মী—মোট ৩ হাজার ৩০ জন আলেম ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ২১৪ লক্ষ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ হাজার ৩০০ লক্ষ টাকা। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী মেয়াদে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বছরের জন্য নতুন করে প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে প্রকল্পটি নতুন করে একনেক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন বন্ধ রয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, দারুল আরকাম প্রকল্পটির ফাইল এখনও একনেকে উপস্থাপন হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তারিখ নির্ধারণের অপেক্ষায় রয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: বেহাল দশা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুই প্রকল্পের
দারুল আরকাম শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও, এর অনেক আগে নতুন প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনকভাবে এখনও অনুমোদন হয়নি। গত ঈদেও বেতন-বোনাস পাইনি, সামনে কোরবানির ঈদ—তবুও বেতন-ভাতার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষক ও সহায়ক কর্মীরা চরম আর্থিক সংকটে রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২০ সালে আমরা এক বছরের বেতন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। এটি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা দ্রুত বকেয়া পরিশোধ ও ঈদের আগেই বেতন দেওয়ার দাবি জানাই।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান বলেন, ‘দারুল আরকাম প্রকল্পটি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। দারুল আরকাম প্রকল্পের ফাইল এখনো বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি। ফাইল ওঠার পরই জানা যাবে, কবে সেটি অনুমোদনের জন্য আলোচনায় আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের নির্ধারিত তারিখ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে তারা বাজেট প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায় এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ জানানো সম্ভব হয়নি। তারপরও আমরা তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি।’