মাদ্রাসার ৭৩ শতাংশ শিক্ষকই প্রশিক্ষণের বাইরে
শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের মূল কাজটি করে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আর এসব শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন-পঠনের গুরু দায়িত্ব থাকে শিক্ষকদের ওপর। একজন শিক্ষার্থী কতটা দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবেন— তা নির্ভর করে তিনি কতটা ভালো শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাগুরুদের বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। এরপরও দেশে এখনও প্রশিক্ষণের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন প্রচলিত ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো তথা মাদ্রাসার শিক্ষাগুরুরা। দেশে বিগত দশ বছরে মাদ্রাসায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ বৃদ্ধির হার বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যা ২০১২ সালে ছিল ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শুরুতে নারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের হার বেশি থাকলেও বর্তমানে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে নারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের হার ৩০ দশমিক ০১ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে দেশে এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে থাকছেন মাদ্রাসার ৮৭ হাজার ৪৩জন শিক্ষক। আর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন মাত্র ৩১ হাজার ৯৬৫জন শিক্ষক।
দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে প্রশিক্ষণের বাইরে রেখে সম্ভব নয় ধর্মীয় আবহ বজায় রেখে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির উদ্যোগ। তাদের মতে, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জোর দিতে হবে বাস্তবমুখী জ্ঞান অর্জনেও। বিপুল সংখ্যক শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে থাকার অর্থ হচ্ছে, এসব শিক্ষক সময়ের সাথে সাথে নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন করছেন না। এখন শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি না পেলে অথবা তাদের ন্যূনতম দক্ষতা না থাকলে তারা শিক্ষার্থীদের সেভাবে দক্ষ করে গড়তে পারবেন না। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা তাদের আগামী দিনের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবে না বলেও মত তাদের।
ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ২৬৮টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ জন এবং এখানে নারী শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর ধর্মীয় এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার ভিত্তিতে পরিচালিত এসব শিক্ষালয়ে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৮ জন এবং এর মধ্যে নারী শিক্ষক মাত্র ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত শিক্ষা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর শতকরা মোট ৩০ ভাগ। পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জড়িত এ জনগোষ্ঠীর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী, সাধারণ শিক্ষার মাঝে বিরাজমান ব্যবধান কমিয়ে আনাসহ গুণগতমান উন্নয়ন ও সুষ্ঠুরূপে পরিচালনা, তদারকি, পরিবীক্ষণ ও অ্যাকাডেমিক পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদারকল্পে সরকার প্রতিষ্ঠা করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকদের যথাযথ দক্ষতা উন্নয়ন করে না করে; তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে ইতিবাচক ফল অর্জন করা যাবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক পাঠদান করছে কিনা বা করবে কিনা—সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে তা কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। আমাদের সবার আগে প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য কোন শিক্ষা-প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক।
এই শিক্ষাবিদ সমাধান হিসেবে মনে করেন, শিক্ষাকে কম বাজেটে রাখার সুযোগ নেই। এখানে সমন্বয় করতে হবে; বাজেট বাড়াতে হবে। আর শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমে আমরা শুরু থেকেই নানা রকম সমস্যা দেখছি তার সমাধান হওয়া দরকার; আমাদের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার। তার জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে সমন্বয় করা দরকার। সরকারের দক্ষ জনগোষ্ঠী বানানোর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যারা কাজ করবে সে শিক্ষকদের কতটুকু দক্ষতা রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের বিএমটিটিআইয়ের মাধ্যমে সারাবছর ধরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন কোর্স হয়। আমাদের দুটো বিশেষ কোর্স আছে; কমিউনিকেটিভ ইংলিশ এবং কমিউনিকেটিভ অ্যারাবিকের উপরে। পাশাপাশি আমাদের প্রশিক্ষক তৈরির জন্য একটি প্রকল্প এবং দেশের ১৮শ’টি মাদ্রাসার জন্য একটি প্রজেক্ট রয়েছে।
দেশের ধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম এ তদারক সংস্থাটির মহাপরিচালক বলছেন, দেশের সকল মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে আমরা আরও প্রকল্প নিচ্ছি। আমরা আশা করছি, এসব প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা আরও বেশি প্রশিক্ষণ দিতে পারব এবং দেশের সব মাদ্রাসার সকল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে পারব। আমরা প্রধানত আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি, শিক্ষকদের চলমান এ প্রশিক্ষণ চলমান থাকবে এবং আমাদের চেষ্টা থাকবে—কোনো শিক্ষক যেন প্রশিক্ষণের বাইরে না থাকেন; তা নিশ্চিত করা।