শিক্ষার্থী কমছে আলিয়া মাদ্রাসায়
রাজধানী ঢাকাসহ শহর অঞ্চলের অল্প কয়েকটি বড় মাদ্রাসা ছাড়া দেশের অধিকাংশ আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে। মাদ্রাসার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশক ধরে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে তুলনামূলক শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গ্রামাঞ্চলের মাদ্রাসা শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়েও কাঙ্খিত মাত্রায় শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছেন না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সংকটে পড়ছে আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) ও উচ্চস্তরের মাদ্রাসাগুলো।
জানা যায়, আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষার পরিসর কমে আসা, আধুনিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মাদ্রাসাগুলো মানিয়ে নিতে না পারা, বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকের স্বল্পতা, ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা না থাকা, উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির বাজারে অবহেলা, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা সংখ্যা কমে যাওয়ায় মাদ্রাসায় প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী স্বল্পতা, মাদ্রাসাগুলো পরিচালনায় স্থিতিশীলতা না থাকা ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির স্বেচ্চাচারিতাসহ নানা কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
রংপুরের একটি আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ক্রমেই দুর্দশার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখন অভিভাবকরা তাদের মেধাবি সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চান না। পরিবারের সবচেয়ে কম মেধাবি সন্তানকে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। আর যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় ভর্তি হয় তারা মূলত আসে অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারণে। স্কুলে পড়ার সামর্থ নেই ভেবে তারা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। আগে অনেক স্বচ্চল পরিবার ইসলামী শিক্ষার জন্য তাদের মেধাবী সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় দিতো। এখন তারা সন্তানদের কওমী মাদ্রাসায় দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আলিয়া মাদ্রাসায় এখন আগের মতো ইসলামী শিক্ষা প্রদানের সুযোগ নেই। পাঠ্যপুস্তক সাধারণ শিক্ষার মতই। কেবল দুই-তিনটি ইসলামী পাঠ্যপুস্তক রয়েছে প্রত্যেকটি শ্রেণীতে। আগামী বছর থেকে তা আরও সীমিত হবে। ফলে যারা ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করাতো তারা আর ভর্তি করাবে না। কারণ আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত।
অন্যদিকে, আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম সাধারণ শিক্ষার আদলে ঢেলে সাজানো হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে অবহেলা। মাদ্রাসাগুলোতে বিজ্ঞানের সাবজেক্ট আছে কিন্তু শিক্ষক নেই, ল্যাব নেই। ফলে যারা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় তারা মূল শিক্ষা পায় না। তারা পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। একইভাবে তারা আইসিটি শিক্ষাতেও পিছিয়ে পড়ছে। এতে দেখা যায়, মাদ্রাসাগুলোতে পাশের হার বেশি, কিন্তু জিপিএ-৫ এর হার একেবারেই কম। ভালো রেজাল্ট ও পরবর্তীকালে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির চিন্তা করে অভিভাবকরা সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চান না।
রাজধানী ঢাকার একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বলেন, আমরা গত একদশক ধরে আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী কমে যেতে দেখছি। একসময় গ্রামাঞ্চলে যে মাদ্রাসাগুলোতে ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতো সেগুলোতে এখন ২০০-২৫০ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। ফলে দাখিল পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের মাদ্রাসা শিক্ষা।
তিনি বলেন, দাখিল স্তরে মাদ্রাসাগুলোতে যে অনুপাতে ছাত্রছাত্রী থাকে আলিম স্তরে এসে তার ২০ শতাংশও থাকে না। দাখিল পরীক্ষায় যারা ভালো ফলাফল করে তাদের সিংহভাগই কলেজে ভর্তি হয়। কারণ দিনশেষে সবাইকে রুটি-রুজির হিসাব করতে হয়। ফাজিল ও কামিল স্তরে যারা ভর্তি হন তারা ক্লাস করেন না, পরীক্ষার সময় হলে পরীক্ষা দেন মাত্র। ফলে মাদ্রাসাগুলো কাঙ্খিত মাত্রায় আলেম তৈরি করতে পারছে না।
আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে অধ্যয়নরত তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাকির হোসেন বলেন, আমরা আলিম পাশ করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বরাবরই ভালো করছে। কিন্তু একই মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়রানী করা হয়। অনেক শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অপমান করে থাকেন।
এছাড়া, চাকরির ক্ষেত্রেও বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান সিভিতে মাদ্রাসা দেখলেই আর সাক্ষাৎকারের জন্য বিবেচনা করে না। এধরনের আচরণ অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। তাই অভিভাবকরা সন্তানদের মাদ্রাসায় দিতে চান না। এই দায় কোনোভাবেই মাদ্রাসার উপর বর্তায় না। আমাদের দেশের কিছু সংকীর্ণ মানসিকতার ‘ডিসিশন মেকারের’ কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহমান। তিনি তার তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে পড়িয়েছেন আলিয়া মাদ্রাসায়। তারা মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কিন্তু আব্দুর রহমান তার ছোট মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াননি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, মাদ্রাসায় আর দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া হয় না। মাদ্রাসা তাই পড়ায় যা স্কুলে পড়ানো হয়। এখন মাদ্রাসা ও স্কুল সমান। তাহলে সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াব কেন?
তবে, শুধু সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মিলে যাওয়ার কারণেই যে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী কমছে তা মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী কমেছে মূলত সেগুলোর অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে দলীয় ব্যক্তির মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার বিষয়টি। যারা এভাবে মাদ্রাসার সভাপতি হয়েছেন তাদের সঙ্গে মাদ্রাসা সুপার ও অন্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব সর্বত্রই। অনেকক্ষেত্রে সহিংসতা এমনকি মামলা পর্যন্ত হয়েছে। এই সংকট চলছে বছরের পর বছর। ফলে মাদ্রাসাগুলোতে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আস্থা ফেরাতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, উপযুক্ত ও দক্ষ শিক্ষকে পাঠদান, মাদ্রাসাগুলোতে বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি, মাদ্রাসা শিক্ষার স্বকীয়তা বজায় রাখা, উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের পরামর্শ দেন তারা।
অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাদ্রাসাগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সঙ্গে আমরা অতীতে আলোচনা করতে চেয়েছি, কিন্তু তারা রাজি হননি। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ মানতে চান না। এটা সত্য যে, কভিডে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থী কওমী মাদ্রাসায় চলে গেছে। তবে, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো শক্তিশালী হলে, শিক্ষকরা পাঠদানে মনোযোগী হলে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কথা নয়।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক ঘাটতি আছে, বিশেষ করে মান সম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের। সেখানে ব্যবস্থাপনা সংকটও আছে। এই বিষয়গুলো সমাধান করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা অবশ্যই ভর্তি হবে।