কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে খোকা আমার!

  © সংগৃহীত

‘মা’ কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু এই ছোট্ট শব্দটির সাথে পৃথিবীর কোন শব্দেরই তুলনা হয় না! একজন নারী যখন প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহন করেন, তখন যে অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করে, সেটা একমাত্র সেই নারীই উপলব্ধি করতে পারে।

আস্তে আস্তে দিন যায়, মাস যায়, তার শরীরের অভ্যন্তরে থাকা সেই মানব শিশুটিও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এভাবেই কেটে যায় নয় মাস কি দশ মাস। তারপর একদিন বহু যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে সেই শিশুটি পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে পায়। আর তার জন্মের সাথে সাথেই সেই নারীটি পায় মাতৃত্বের স্বাদ!

সেদিন থেকে সেই নারী শুধু আর নারীই থাকেনা, তার নতুন একটি পরিচয় হয়,  তিনি একজন ‘মা’।বহু কষ্ট করে বাচ্চাটিকে লালন-পালন করতে থাকেন মা। হাটি-হাটি, পা-পা করে বড় হতে থাকা শিশুটি একদিন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এই প্রথম মা আর সন্তানের বন্ধনের দড়িটা কিছুটা হলেও শিথিল হয়।

সকাল সকাল বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া, বাসায় আসা, সেবা যত্ন করা, ঘুম পাড়ানো, সন্ধ্যার সময় বাচ্চাকে নিয়ে পড়তে বসানো, এভাবে দিন যায়। সেই সঙ্গে মায়েরও দায়িত্ব বাড়তে থাকে। স্কুল থেকে কোচিং, কোচিং থেকে বাসায়, আসতে আসতে সন্ধ্যা, সংসারের কাজ! 

একজন মানুষ কতইবা আর কাজ করতে পারে। কিন্তু মায়ের মুখে অসন্তোষের কোন চিহ্ন নেই। মা যেন হাসিমুখেই সবকিছু করে যাচ্ছেন। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবেই মা আর সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক দিন দিন শিথিল হতে থাকে আর সেই জায়গাটা দখল করে নেয় বন্ধু, বান্ধবীরা। 

মা, বারান্দার গ্রীলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন আসবে তার খোকা! সে নিজে ভাত না খেয়ে অপেক্ষা করে, খোকা আসলেই একসাথে খাবে!  কিন্তু খোকা তো আর আসেনা। কারণ খোকাতো এখন ভীষণ ব্যস্ত তার বান্ধবী, বন্ধু এবং চাকরী নিয়ে।

কত রাত গিয়েছে মায়ের না ঘুমিয়ে, বিছানায় খোকার শিয়রের কাছে বসে থেকেছে কারণ তার খোকার যে ভীষণ জ্বর!  এভাবে দিন যায়, বছর যায় খোকা আর মা’র সম্পর্কটাও দিন দিন বদলে যায়।

একদিন ছেলে এসে মায়ের কাছে বলল মা, আমার স্কলারশিপ টা হয়ে গিয়েছে। এখন যে আমায় চলে যেতে হবে আমেরিকায় পিএইচডি করতে। ও আর একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, ‘আমি আর মিতুল বিয়ে করে ফেলেছি। মিতুলের ফ্যামিলি থেকে চাপ দিচ্ছিল তাদের পছন্দে বিয়ের জন্যে, তাই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলেছি। এখন তুমি ওদের বাসায় যাও, আসল ঘটনা খুলে বলো, তারা রাজি না হলেও ক্ষতি নেই, কারণ এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী।

নাজনীন আক্তার

মিতুলের পাসপোর্ট করা হয়ে গিয়েছে, আমরা দুজনেই একসঙ্গে চলে যাব। ওরও ইচ্ছে এমএস’টা করে ফেলার। কি মা যাচ্ছো তো মিতুলের বাসায়?

আমি যেন একটা ঝাকি খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসলাম। এটা কি শুনলাম!  কি বলল খোকা আমাকে। স্বপ্ন দেখলাম না তো...., না!  ওই তো খোকা, বের হয়ে যাচ্ছে....! কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে খোকা আমার!

আমাকে কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করল না, যে ছেলে একদিন মায়ের হাত ধরে হাটি হাটি পা পা করে হাটতে শিখেছিল, মাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতো না, যে ছেলে একদিন স্কুল থেকে এসে মা’র গলা জড়িয়ে ধরে প্রথম বলেছিল, ‘Happy mother's day, my mom is the best mom in the world’- কতই না খুশী হয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম, যাক বাবা! আমার ছেলে অন্তত বড় হয়ে মাকে ভুলে যাবে না। আজকালকার ছেলে মেয়েদের মত মাকে অসম্মান করবে না। আমি তাকে ভালোই শিক্ষা দিতে পেরেছি। কিন্তু আসলেই কি দিতে পেরেছিলাম? 

তাহলে কেন আজ সবকিছু আমার কল্পনার বিপরীতে চলে গেল? সব দোষ কি তাহলে ওই মিতুল মেয়েটির? তাকে পেয়েই কি ছেলে তার মাকে ভুলে গেল? হঠাৎ অল্প কিছুদিনের পরিচয় এতই মুল্যবান হয়ে গেল মায়ের মমতার তুলনায়?

কি আর করা! ছেলে বড় হয়েছে, নিজের কষ্ট বুকে রেখেই একদিন চলে গেলাম ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে, সব ঠিকঠাক মত হয়ে গেল।  সেই দিনটি চলে আসল। মনে হলো খুব তাড়াতাড়িই চলে আসল। ছেলে আর তার বউ চলে গেল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। 

কে জানতো, এভাবেই খোকা আমার চলে যাবে। এই যাওয়াটাই বোধ হয় শেষ যাওয়া হবে মা ছেলের একই ছাদের নীচে থাকার। এখন আর কান্না আসে না। সব কিছু মানিয়ে নিয়েছি, নিজেকে এই বুঝ দিয়েছি, দুনিয়াতে আসলে কেউ কারো জন্যে নয়। সবাই আসে তার স্বার্থের জন্যে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

আজকাল চোখেও খুব একটা দেখতে পাই না। পাশের দুটো রুম ভাড়া দিয়েছি। তারাই আমাকে মাঝে মাঝে দেখা শোনা করে। প্রথম প্রথম খোকা মাঝে মাঝে ফোন করত। পরেরদিকে তেমনটা আর না, শুনেছি তাদের নাকি জমজ বাচ্চা হয়েছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। তাই নিয়ে দুজনেই খুব ব্যস্ত থাকে।

হঠাৎ পাঁচ বছর পর খোকা একদিন এসে হাজির। কিছুই জানায়নি, এসেছেও একা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

'তুই একা এসেছিস ? বাচ্চাদের নিয়ে আসলে দেখতে পারতাম... 

মা, তুমি যে কি বলো না....!  দেশের এই আবহাওয়ায়? এত্ত গরমে ওরা থাকতে পারবে। তারপর এই পুরোনো বাসায়? এরা উন্নত বিশ্বের বাচ্চা! এদেশে এরা মানিয়ে চলতে পারবে না! 

বাদ দাও সেইসব কথা, যে জন্য দেশে এসেছি আমি, সেটা আগে বলে নেই। মা, বুঝতেই পারছো, আমার পক্ষে দেশে এসে থাকাতো আর কখনোই সম্ভব নয়। আর তুমিও এভাবে একা একা এত্ত বড় বাড়িতে থাকতে পারো না, আর থাকাও উচিৎ নয়। কারন কখন কি হয়ে যায়। কে দেখবে তোমাকে। 

তাই ঠিক করেছি এই বাড়িটা বিক্রি করে দিব। তুমি বৃদ্বাশ্রমে গিয়ে থাকবে। ওখানে অনেকে আছে, তোমার মোটেও একা একা লাগবে না, সবাই তোমাকে দেখে রাখবে। আমি মাসে মাসে না হয়, টাকা পাঠাব। আর সময় পেলে তোমাকে দেখে যাব।

সাতদিনের জন্য এসেছি, তুমি বাড়ির দলিলে সই করে দিলেই হবে, যারা কিনবে তাদের সাথে আমার সব ডিল হয়ে গিয়েছে আমেরিকা থেকেই, এখন শুধু তোমার সই টা লাগবে। 

স্বামীর নিজের হাতে গড়ে তোলা বাড়িটি শেষবারের মত দেখে নিচ্ছিলাম। কত স্মৃতি! কত হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ জড়িয়ে আছে এই বাড়িটির সঙ্গে। ছাদের বাগান, ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে চা খাওয়া, পাশের গাছটিতে চড়ই পাখীদের কিচির মিচির শব্দ, আর দোলনাটিতে বসে খোকার দোল খাওয়া।

সবই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল! মা, এসে পড়েছি আমরা।খোকার ডাকার শব্দে আমি যেন বাস্তবে ফিরে আসলাম, একটা পুরনো দোতলা বাড়ির বারান্দাতে আমার মত কয়েকজন বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম।

খোকার বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি একাই খোকাকে লালন পালন করেছি, সংসারের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করেছি। কখনও নিজের কথা ভাবিনি। আমার পরিবার থেকে অনেকেই বলেছিল আবার বিয়ে করতে কিন্তু আমি করিনি।

আমার কাছে তখন আমার নিজের থেকেও খোকার প্রয়োজনটা বেশী ছিল। মনে হয়েছিল, সারাটি জীবন আমি খোকাকে নিয়ে এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারব! হায় রে মন! মানুষ যা ভাবে তা কি আর সব হয়। আমি খুব অভিমানী টাইপের ছিলাম, যার কারণে। এই পর্যন্ত খোকার কোন কাজেই আমি তাকে প্রশ্ন করিনি। সে যা করছে, সব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি। 

কোন প্রতিবাদ করিনি। হঠাৎ খোকা বলে উঠল, মা, আমাকে যে যেতে হবে। আমি এতক্ষণ সব ফর্মালিটিস শেষ করলাম। তোমার কোন অসুবিধে হবে না, থাকো তাহলে! 

কি বলব আমি খোকাকে? কখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম? যার জন্য আমি আমার জীবনটাকেই শেষ করে দিলাম, সেই ছেলে কিনা একদিন মৃত্যুর পুর্বেই আমাকে মেরে ফেলবে! আমি কি বেঁচে আছি! এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে! 

ওই তো খোকা চলে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে। চলে যাচ্ছে, খোকা একটিবার. একটিবার বাবা ফিরে আয়... ফিরে আয়। এসে বল... মা, আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি। আর আমরা আলাদা থাকব না, আমরা আগের মত আমাদের বাড়িতে থাকব। তুমি বারান্দার ইজিচেয়ারটায় বসে চা খাবে, আমি দোলনা খেলব। কামিনি আর হাসনাহেনার গন্ধ আর পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ।

মা, চলনা আমরা আবার ফিরে যাই আমাদের দুজনের সেই আনন্দের দিনগুলোতে!

মা.......। কে? কে ডাকলো আমায় মা বলে? ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি খোকা দাঁড়িয়ে। তোমাকে একটা জিনিষ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই আসতে হলো। এই বলে সে পকেট থেকে একটা খাম বের করল, খাম খুলে কয়েকটা ছবি বের করে দিল।

এই নাও মা, তোমার নাতি নাতনীর ছবি।

আমি নিলাম ছবি গুলো, দেখতে লাগলাম। যদিও কিছুই দেখতে পারছি না। সব কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে! চোখের ছানি কাটতে হবে, কিন্তু! 

খুব সুন্দর, ওর মায়ের মতই হয়েছে, তাহলে এখন আসি! 

কি বলব! কি বলব খোকাকে! না ! তুই যাসনে খোকা আমাকে ছেড়ে। আমি যে বাবা তোকে ছাড়া একদিনও একা থাকতে পারব না। না, বলতে পারিনি! কারন আমি যে খুব অভিমানী! নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারি না! 

মা, যাচ্ছি, তুমি ভালো থেকো.... 

হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসল, খোকাকে বললাম,তোমার সাথে কি আর কখনওই দেখা হবে না?

হবে না কেন, অবশ্যই হবে, বেচে থাকলে অবশ্যই হবে। এবার তাহলে আসি..

হুম বেচে থাকলে, সত্যিই তো! বেচে থাকলে তবেই তো দেখা হবে! এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যে অন্ধকার হয়ে আসল, টেরই পেলাম না। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার!

কিছু মানুষের চিৎকার। তাড়াতাড়ি কে আছো এখানে এসো, আজকে যে অতিথি আসলেন, সে তো মাটিতে পড়ে রয়েছে।তাড়াতাড়ি বড় আপাকে খবর দাও। কি হয়েছে? 

আরে উনি তো আজকেই এখানে আসলেন, তার ছেলে দিয়ে গেল। পড়ে রয়েছে কেন? তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকো।

এই যে ডাক্তার সাহেব এসেছেন।

দেখি তো, ভীড় ছাড়েন সবাই।আমাকে দেখতে দেন.....। ‘Sorry! She is no more..... 

আজকেই আসলেন, রুমেও যাননি এখনো পর্যন্ত! 

হুম! তিনি তার কথাটি রেখেছেন, হয়তো ছেলেকে ছাড়া একদিনও বাচতে চাননি। তাইতো অভিমান করে চলে গিয়েছেন। হায় রে অভাগা মা।

আজ বিশটি বছর পর, সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে খোকা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, কিছুই দেখতে পারছে না। হাতে কতগুলো চিঠি ধরা, ঠিক যেমনটি সেদিন মায়ের হাতে কতগুলো ছবির খাম ধরিয়ে দিয়েছিলাম, তেমনি করে এই প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার আমার হাতে কতগুলো চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো আপনার মা’র ব্যাগের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছি, যদি কোনদিন আপনি আসেন, তাহলে দিব।

আমি চিঠিগুলো খুললাম, দু তিন টি লাইন করে লেখা প্রতিটি চিঠিতে। ‘খোকা তোকে ছাড়া একা থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়’। ‘খোকা তুই কবে আসবি রে, বারান্দায় বসে তোর দোলনাটার দিকে তাকিয়ে থাকি, মনে হয় তুই বসে আছিস!’

খোকা তোর কি মনে পড়ে, সেই প্রথম তুই আমাকে উইশ করেছিলি, ‘ Happy mother's day, you are the best mom in the world’।

হ্যা মা, আমি সেদিন সত্যিই বলেছিলাম। তুমি হচ্ছো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, আমার কাছে। মা, আমি আর একটিবার বলতে চাই তোমাকে, Happy mother's day.... 

জানি তুমি আজ বহুদুরে, এটাও জানি তুমি আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছো। আজ তোমার ছেলে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যে জায়গায় আজ থেকে বিশ বছর আগে তোমার খোকা তোমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল! প্রকৃতি প্রতিশোধ নিয়েছে, আজ আমিও খুব একা। শুধু মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে বেচে ছিলাম এতদিন! পারলে আমায় ক্ষমা করো মা। যদিও জানি .... আমি ক্ষমার যোগ্য না!

লেখিকা: সাবেক ছাত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ