১১ মে ২০২৫, ০৯:০৮

হেলাল হাফিজের তিন কবিতা 

হেলাল হাফিজ  © সংগৃহীত

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—এই পঙক্তির মধ্য দিয়েই হেলাল হাফিজ বাংলা কবিতায় চিরকালীন হয়ে উঠেছেন। প্রেম ও প্রতিবাদের ধারাকে এক সুতোয় গাঁথা এই কবি, আজ সব প্রেম আর সমস্ত যুদ্ধ পেরিয়ে চিরস্থায়ী হলেন কবিতার ভুবনে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর এই কবিতার লাইন দুটি পরিণত হয়েছিল তরুণ প্রজন্মের মন্ত্রে। শুধু ১৯৭১-ই নয়, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও একই উন্মাদনায় জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল হেলাল হাফিজের কলম।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’— যা তাঁকে রাতারাতি এনে দেয় বিপুল খ্যাতি। বইটির ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ। তবে সাফল্যের শিখরে থেকেও কবি দীর্ঘ সময় ছিলেন আড়ালে, নীরবে।

প্রায় আড়াই দশক পর, ২০১২ সালে তিনি ফিরে আসেন ‘কবিতা ৭১’ নিয়ে। আর ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’। হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু প্রেম বা ব্যক্তিক অনুভব নয়, তা ছিল এক জাতির আত্মপ্রকাশ, এক সময়ের সাক্ষ্য। আজ তিনি আর নেই, কিন্তু বাংলা কবিতা জগতে তাঁর উপস্থিতি রয়ে যাবে চির ভাসমান এক দীপ্ত প্রতীক হয়ে।


হেলাল হাফিজের তিন কবিতা দেখুন--

নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।


একটি পতাকা পেলে

কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।


ফেরীঅলা

কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট!
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।