বঙ্কিমের মশা
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তটা কেমন যেন উদাস প্রকৃতির। প্রত্যহ যা মনকে উদাস করে নিয়ে যায় এক বিচিত্র জগতে। এই সময়টা প্রায়ই কোনো না কোনো জানালার পাশে বসে কাটাই। অধীর হয়ে ব্যাকুল চিত্তে প্রাণ খুলে তাকিয়ে থাকি পশ্চিমাকাশের পড়ন্ত সূর্যের দিকে।
এমনই কোনো এক সন্ধ্যার পূর্বে বিজ্ঞদের ন্যায় কপালের একপাশে হাত রেখে চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে ভাবছিলাম, মহাবিশ্বের অন্ত সীমা নিয়ে। হঠাৎ দেখি শেষবেলার এক অতিথি এসে জানালার উপরের বিশেষ অসংরক্ষিত আসনটি দখল করেছেন। সঠিক অনুমান সম্ভবপর না হলেও আঁচ করতে পারলাম, উনার বয়সে পাক ধরেছে অনেক আগেই। কিন্তু নিভু নিভু অবস্থায় এখনও তার শেষ বাতিটা জ্বলছে।
তারপর মূল ঘটনার সূত্রপাত। জানালার উপরে বসে থাকা বিশেষ অতিথি আমাকে অবাক করে মানুষের স্বরে একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করলেন। বুঝলাম দিব্যকর্ণপ্রাপ্ত হয়েছে। অস্পষ্ট হলেও অতিথির প্রথম কথাটা ছিলো, ‘কেমন আছেন মশাই?’ সামান্য অপ্রস্তুত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জবাব দিলাম, ‘জ্বি মশাই, আছি বেশ।’ বিষয়টা উনার কাছে কিছুটা অপ্রতিভ ঠেকলেও বেশ ভাবুকের ভঙ্গিতে গভীর কণ্ঠস্বরের সাথে বললেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আপনাকে কাটতে আসেনি।’
বুঝলাম মশাইয়ের অনেক ভাব! তবুও সৌজন্যের খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো কেমন যাচ্ছে আপনার দিনকাল?’ ভারি ক্লান্তি ও লজ্জার সহিত বললেন, অবহেলিত, ঘরকুনো, ভীরু, অকর্মা লোকের যেমন যাওয়া উচিৎ তেমনই যাচ্ছে। কথাটা নিজের কাছে কেমন কেমন লাগলেও কিঞ্চিত উৎসাহের সাথে বললাম, আপনার কথাটা ঠিক ভালো করে বুঝতে পারলাম না। অতঃপর তিনি শুরু করলেন নিজের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার কথা।
মহাশয়, ‘তবে শোনো, আমার পুরুষজাতি কোনো এক সময় ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী, কর্মঠ এবং ভয়ংকর প্রাণী। যাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ প্রাণীকুল নিজেদের করুণ অবস্থার কথা চিন্তা করে জলজ প্রাণী হওয়ার নিষ্ফল প্রত্যাশা করতো। কিন্তু সবকিছু বিনাশ হয়ে গেল অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানেই। আমাদের সম্মানিত পশ্চিমা পূর্বপুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা ও ভরসা করে তাদেরকেও আমাদের সেই মহান দংশননীতি ও তার প্রয়োগ শিখিয়ে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে এক চরম অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হলো। অল্প সময়ের ব্যবধানেই আমাদের পূর্বপুরুষদের সকল ক্ষমতাও কাজকর্ম থেকে নিষ্পত্তি দিয়ে তারা নিজ হাতে ক্ষমতা তুলে নিলেন। যা ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের সবচেয়ে লজ্জার ইতিহাস। তবুও তারা কিছুটা কথা বলতে শুরু করেছিলো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। ফলস্বরূপ গৃহবন্দীর পুরষ্কার লাভ করলো তাঁরা। যদিও পরবর্তীতে কিছুটা মুক্তি মিলেছে। তবে আজও অধিকাংশই এর বাহিরে অবস্থান করছে।’
হঠাৎ সবকিছু বিনাশ করে ধড়মড় করে উঠলাম। অল্পক্ষণের দারুণ নিদ্রাটার অবসান ঘটলো। বুঝতেই পারলাম না কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল। একটু পর অনুভব করলাম পায়ে কিছু একটা কামড়েছে। বুঝতে পারলাম, পুরুষ মশাটা গল্প শোনানোর ফন্দি করে স্ত্রী মশাকে দিয়ে রাতের কাজটা আগেই সেরে ফেলেছে।
তবে গল্পের কথা মনে পড়তেই কিছুটা সতর্কতার ভঙ্গিতে ঠিক হয়ে বসলাম। ভেবে দেখলাম তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস থেকে আমাদেরও কিছু শেখার আছে। তখনও পশ্চিমাকাশে সূর্যটা পুরোপুরি ডুবেনি। অন্ধকার হতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে। তাই সময় থাকতেই সতর্কতা অবলম্বন করে ভালোভাবেই কাজে লেগে গেলাম। বলা তো যায় না, পরে যদি আরও করুণ কোন গল্প শুনতে হয়!
আল আমিন অপু,
শিক্ষার্থী: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়