সাহিত্য আর ভাষাতত্ত্বের জীবনশিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলী
একাধারে বহু ভাষাবিদ, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও সবচেয়ে বেশি পরিচয় একজন রম্য-সাহিত্যিক। এসব পরিচয়ের বাইরে তিনি বাঙালি শিশু-কিশোরদের কাছে বেশি জনপ্রিয় ভ্রমণ কাহিনির জনক হিসেবে। আফগানিস্তান, কাবুল, পাগমানের বরফাচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র পাহাড় কিংবা দূর দেশের খাদ্য-সংস্কৃতির নিরেট বর্ণনা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো আর কেউই সদা হাস্যে দিতে পারেননি।
সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা’র ভাষার পাশাপাশি ফরাসি, ফারসি, আরবিসহ মোট ২৩টি ভাষা জানতেন। বহু ভাষাবিদ এই লেখকের ভাষাগত মুন্সিয়ানা তার লেখায় উঠে আসতো সবসময়ই। সৈয়দ মুজতবা আলীর সহধর্মিণীর অভিযোগ ছিল, তাদের ছেলেমেয়েরা তার (সৈয়দ মুজতবা আলী) মতো হয়েছেন; এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তার নির্লিপ্ত জবাব ছিল, ‘ছেলেমেয়েদের বলো আমার মতো ২৩টা ভাষায় কথা বলতে।’
বিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম জনপ্রিয় ও শক্তিশালী বাঙালি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের আসাম অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। তার পৈতৃক ভিটা মৌলভীবাজার আর পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার উত্তরসূর গ্রামে। সৈয়দ মুজতবা আলীর পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী ছিলেন পেশায় একজন সাব-রেজিস্ট্রার।
পিতার বদলির সুবাদে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরপর সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি এবং ১৯২১ সালে তিনি ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের এই শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে সেখান থেকে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় সহ ২৩ ভাষা ও পরবর্তীতে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য তিনি বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি লাভ করেন ডি.ফিল ১৯৩২ সালে। এরপর তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুজতবা আলী কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনার মধ্যদিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি শিক্ষকতা করেছেন ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে। বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৩৫ সালের দিকে। এর আট বছর বছর পর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন মুজতবা আলী।
পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৯ সালে। কর্মজীবনে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন পঞ্চাশের দশকে। কাজ করেছেন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে। দায়িত্ব সামলেছেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লির মতো স্টেশনে। তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৬১ সালে। এরপর বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান এবং অবসরে যান ১৯৬৫ সালের দিকে।
‘যত কঠিনই আসুক না কেন, সত্যরে লও সহজে’--এমন সাত্ত্বিক ব্রত নিয়ে মুজতবা আলী জীবন পার করেছেন সদাহাস্য-রসে। সত্য বলায় তার কৃতিত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি নিরেট, নির্ভেজাল কিংবা শুভ্র-সত্যকে তিনি অন্যের মনঃক্ষুণ্ন না করে প্রকাশ সংকোচ-হীনভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। হাসতে হাসতেও যে কঠিন সত্য বলে দেওয়া যায়, তার স্পষ্ট ও তার প্রাঞ্জল উদাহরণ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী।
তার রচিত ছোটগল্প ,অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনি ও উপন্যাসের সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে, জলে ডাঙ্গায়, ময়ূরকণ্ঠী, চাচা কাহিনি ও পঞ্চতন্ত্র অন্যতম। তবে ‘শবনম’কে গণ্য করা হয় সৈয়দ মুজতবা আলী’র কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে। তুর্কি বংশোদ্ভূত তরুণী শবনমের সাথে বাঙালি যুবকের প্রথম দেখা, প্রেম ও বিরহের পরিশীলিত দলিল এটি।
বহু ভাষাবিদ এই লেখক কর্মজীবনও পার করেছেন বহু কর্মের মাধ্যমে। বাবার চাকরি ও নিজের পড়াশোনার সুবাদে বিভিন্ন স্থানে থাকা ও নানাবিধ মানুষের সাথে তার পরিচয় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় ফুটেছে সাবলীলভাবেই। দেশে ও দূরদেশে নানাস্থান ও নানা কর্মপদে যুক্ত থাকলেও সৈয়দ মুজতবা আলী জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পার করেছেন শিক্ষকতা ও সাহিত্য রচনায়।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব এর শিক্ষার্থী ও এই শিক্ষকের ধর্ম-দর্শন নিয়ে তার বড়ভাইয়ের মন্তব্য ছিল অনেকটা হতাশার। সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যে কখনো ধর্মীয় সংকীর্ণতা যেমন ছিল না, তেমনি কখনো অতি উদারীকরণও ছিল না। কিন্তু, তার এই মার্জিন মেনে চলা অর্থাৎ এমন উদারতার জন্য ধর্মীয় গোঁড়া স্বধর্মীদের দল তার সমালোচনা করতে কখনো কুণ্ঠিত হয়নি কিংবা কোনোদিন ক্ষমা করে কথা বলেনি। যখন যেখানেই ছিলেন প্রবল রসাত্মক এই লেখক চলমান সময়কে আপন করেছেন স্বমহিমায়। কঠিন সত্যকেও বলেছেন সহজ-সরল হাস্যরসে; কথা বলেছেন মাথা দিয়ে।
শান্তি-নিকেতনে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে ‘আজকে ছুটি’র নোটিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জব্দ কৃত গাঁজা পোড়ানোর পর সে রাতে হাতি, ঘোড়া কিংবা জীপে করে বাড়ি ফেরার নির্ভেজাল বর্ণনা তো তার ছোটগল্পেরই অনন্য সৃষ্টি। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না,’ কিংবা সুন্দরীর ঠোঁটের লিপস্টিক ডার্ট নয়, যখন তা আমার ঠোঁটে লাগে তখন তা হয় ডার্ট(ময়লা)’ এমন সব বিখ্যাত উক্তি সৈয়দ মুজতবা আলীকে রম্যপ্রিয় বাঙালির মানসপটে জিউয়ে রাখবে সদা-সর্বদা।
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখক জীবনের গোঁড়ার দিকে তখন তিনি জনপ্রিয় হচ্ছেন তখন প্রতিদিন তাকে দেখতে পাঠকরা তার বাড়িতে আসতেন এবং জানতে চাইতেন তিনি কীভাবে এমন সব সাহিত্য রচনা করেন। তখন তিনি এক বিলেতি সাহিত্যিককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আপনি চাইলে আমার সন্তানদের দেখাতে পারি, কিন্তু, সন্তান কীভাবে উৎপাদন করি তা তো আর দেখাতে পারবো না।’
এমন নির্লিপ্ত সত্য জবাবে হয়ত কেউ আর কখনো সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য রচনা কীভাবে করতে হয় জানতে না চাইলেও তার রম্য সাহিত্য রসিক বাঙালির দল যুগ যুগ ধরেই জানতে চাইবে। চির রসিক ও সত্যপ্রিয় এই বাঙালি সাহিত্যিক জন্মেছিলেন আজকের এই দিনে। পাগমানের শ্বেতশুভ্র পাহাড়ে সৈয়দ মুজতবা আলী না থাকলেও আজন্ম তিনি বাঙালি মানসপটে সত্যা-সত্যে অমর থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরের বাঙালির ‘একজন আলী সাহেব’ বা ‘সৈয়দ মুজতবা আলী’ হয়ে।