কয়েন বা মুদ্রার আবিষ্কার রহস্য

বশিরুজ্জামান বশির: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে যে কয়েন বা মুদ্রার ব্যবহার ছিল তা এখন আর নেই বললেই চলে। স্বাধীনের পর আমরা ব্যবহার করেছি-  পাঁচ পয়সার মুদ্রা, দশ পয়সার মুদ্রা, পঁচিশ পয়সার মুদ্রা, পঞ্চাশ পয়সার মুদ্রা এগুলো যুগে যুগে হারিয়ে গেছে। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে এক টাকার মুদ্রা, দুই টাকার মুদ্রা ও পাঁচ টাকার মুদ্রা। এগুলোও হয়তো যুগে যুগে হারিয়ে যাবে। তবুও বর্তমান প্রজন্মের জন্য কয়েন বা মুদ্রার ইতিহাস জানা জরুরি। তাই মুদ্রার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র।

মুদ্রা বলতে সাধারণত এমন একটি ধাতব খণ্ডকে বুঝায়, যার একটি নির্দিষ্ট ধাতব বিশুদ্ধি (মেটালিক পিওরিটি) এবং নির্দিষ্ট তৌলরীতি (ওয়েট স্ট্যান্ডার্ড) আছে। নির্দিষ্ট তৌলরীতির ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট ধাতব বিশুদ্ধির ওপর নির্মিত এই ধাতব খণ্ড যখন বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত ও ব্যবহৃত হয় তখন তা মুদ্রা বলে গণ্য হয়ে থাকে। মুদ্রার তৌলরীতি ও ধাতব বিশুদ্ধিকে নিশ্চিত ও স্থিরীকৃত করতে কোনো বিশেষ এলাকার সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তি মুদ্রার ওপর নানা প্রতীক, নকশা ও লেখ উৎকীর্ণ করার ব্যবস্থা নেয়। বিভিন্ন প্রকার মুদ্রা সংগ্রহ ও তার গবেষণা হলো মুদ্রা সংক্রান্ত বিদ্যা। এ মুদ্রাই প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠনে ইতিহাসের পুরাতাত্ত্বিক সূত্র হিসেবে কার্যকরী একটি মাধ্যম। মুদ্রায় অঙ্কিত প্রতীক, নকশা ও লেখ কোনো এক সার্বভৌম রাজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে, আবার সেগুলো সামগ্রিকভাবে কোনো বিশেষ রাজবংশের সঙ্গেও জড়িত হতে পারে।


মুদ্রার দুই পিঠের মধ্যে যেটিতে শাসকের পরিচিতি ও ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিকৃতি দেখা যায়, সেটি মুখ্য দিক (অবভার্স) বলে স্বীকৃত। তার অপর পিঠে বহুক্ষেত্রেই খোদিত থাকে ঐ রাজা বা তার বংশের প্রতিকৃতি; এই পিঠটি মুদ্রার গৌণ দিক (রিভার্স) বলে উল্লিখিত হয়। গৌণ দিকেও লেখর ব্যবহার থাকতে পারে। মুদ্রার মুখ্য ও গৌণ দিক থেকে কোনো শাসক বা কোনো রাজবংশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিবিধ তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব। উপরন্তু মুদ্রার আলোকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং শিল্পকলা সংক্রান্ত তথ্যও গোচরীভ‚ত হয়। তবে মুদ্রা যেহেতু প্রাথমিকভাবে বিনিময় ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত, তাই অর্থনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে কোনো বিশেষ আমলের বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ বোঝার জন্য মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম।


উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় যদিও খ্রিস্টপূর্র্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকে মুদ্রার ব্যবহার নিয়মিত হয়ে যায়; কিন্তু প্রাচীন বাংলায় মুদ্রার অস্তিত্ব আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পূর্বে প্রমাণ করা কঠিন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উত্তরবঙ্গ সম্ভবত মৌর্য শাসনাধীনে আসে। বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র মহাস্থান থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের যে লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে জানা যায়, পুণ্ড্রনগরে (বাংলার প্রাচীনতম নগর, বর্তমান মহাস্থানগড়ে তার ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত) অবস্থিত রাজকোষে ‘গণ্ডক’ ও ‘কাকিনী’ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক পণ্ডিতের মতে ‘গণ্ডক’ ও ‘কাকিনী’ দুই প্রকার মুদ্রার নাম, যা তৎকালীন উত্তরবঙ্গে ব্যবহৃত হতো। একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে ৪টি (গণ্ডা)-র হিসাবে কড়ির এক প্রকার একককে বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে কড়ির ব্যবহার জানা ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকে বাংলায় ধাতব মুদ্রার উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে উৎখনিত প্রত্নক্ষেত্র থেকে। নিম্নলিখিত প্রত্নক্ষেত্রগুলো থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বহু রৌপ্য নির্মিত ‘অঙ্কচিহ্নিত’ মুদ্রা : মহাস্থানগড় (বাংলাদেশ), বাণগড় (দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), মঙ্গলকোট (বর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), চন্দ্রকেতুগড় (উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ); এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ।
কুষাণদের পূর্ণাহত (ডাই-স্ট্রাক) তাম্রমুদ্রা ছাড়াও কুষাণ বংশীয় রাজাদের ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত ছিল। এই জাতীয় ছাঁচে ঢালা কুষাণ মুদ্রার মুখ্যদিকে দণ্ডায়মান কুষাণ সম্রাট ও গৌণ দিকে দণ্ডায়মান দেবতা মাও-এর প্রতিকৃতি চোখে পড়ে। পুরুলিয়ার ৫১.৫০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত মসুয়াবাজারে ২৮১টি ছাঁচে ঢালা কুষাণ তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে (বর্তমানে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত)। এই ছাঁচে ঢালা কুষাণ তাম্রমুদ্রার সঙ্গে অনুকৃত কুষাণ-বঙ্গ বা কুষাণ-রাঢ় তাম্রমুদ্রার কয়েকটির ওজনের সাদৃশ্য লক্ষ্য করার মতো। কলকাতার আশুতোষ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত এই জাতীয় একটি মুদ্রার ওজন ৩.৬৩ গ্রাম। এর থেকে অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে, বাংলায় প্রচলিত ছাঁচে ঢালা কুষাণ তাম্রমুদ্রাগুলোও কার্ষাপণ তৌলরীতি (৫৭.৬ গেণ এবং ৩.৬৫ গ্রাম) অনুসরণ করে তৈরি হয়েছিল। সমকালীন উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চলে যে ‘পুরী-কুষাণ’ জাতীয় তাম্রমুদ্রা ব্যবহার করা হতো, তার সঙ্গে কুষাণবংশীয় ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রার আকার ও ওজন উভয়েরই সাদৃশ্য আছে। যদিও ‘পুরী-কুষাণ’ তাম্রমুদ্রা এবং ‘কুষাণ-বঙ্গ’ বা ‘কুষাণ-রাঢ়’ তাম্রমুদ্রা অভিন্ন নয়, তবুও এই দুই প্রকারের তাম্রমুদ্রার সাদৃশ্য ইঙ্গিত দেয় যে, অন্ধ্রের উত্তরভাগ, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ (বিশেষত তটীয় এলাকা) এবং দক্ষিণ বিহারজুড়ে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এক জটিল মুদ্রাব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। এই জটিল মুদ্রাব্যবস্থার সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রায় চতুর্থ শতক পর্যন্ত ৫০০ বছর ধরে।


লক্ষণীয় ঘটনা এই যে, যখন থেকে বাংলায় স্বর্ণমুদ্রা অদৃশ্য হলো, সেই একই সময়ে হরিকেল ও পট্টিকের অঞ্চলে বহুল পরিমাণে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন শুরু হলো। হরিকেলের রৌপ্যমুদ্রার সর্বাধিক তাৎপর্য তার অতি উচ্চ ধাতব বিশুদ্ধি। এই মুদ্রার মুখ্যদিকে বিদ্যমান একটি উপবিষ্ট বৃষের প্রতিকৃতি এবং ‘হরিকেল’ এই স্থান নাম, গৌণদিকে একটি ত্রিমুখী নকশা। ‘হরিকেল’ নামটির হরফ বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ঐ লেখ সম্বলিত মুদ্রাগুলো খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে নির্মিত। পূর্ণাঙ্গ ওজনের একক বিশিষ্ট হরিকেলী রৌপ্যমুদ্রার ওজন ৮ গ্রাম। অতএব, ৬ গ্রাম ওজনের মুদ্রাগুলো পূর্ণাঙ্গ ওজনের ২/৩ অংশ; ৪ গ্রাম ওজনের মুদ্রাগুলো ১/২ অংশ এবং ২ গ্রাম ওজনের মুদ্রাগুলো ১/৪ অংশ। হরিকেলের রৌপ্য মুদ্রাব্যবস্থা সম্ভবত নিকটবর্তী আরাকানের চন্দ্র শাসকদের রৌপ্যমুদ্রার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে হরিকেল মুদ্রার সঙ্গে সাদৃশ্যসম্পন্ন রৌপ্যমুদ্রা প্রচলিত হয় পট্টিকের অঞ্চলে (কুমিল্লা এলাকা)। মনে হয় পট্টিকের রৌপ্যমুদ্রা হরিকেলের রৌপ্যমুদ্রার আদলে নির্মিত। উল্লেখ্য, হরিকেল বা পট্টিকের কোনো এলাকার রৌপ্যমুদ্রাতেই কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা শাসকের নাম নেই।


মুসলিম শাসনব্যবস্থায় শাসকের স্বনামে মুদ্রা প্রচলন এবং খুৎবায় নিজ নাম প্রচার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এজন্য ক্ষমতা গ্রহণ অথবা স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজয়কে স্মরণীয় করার জন্য শাসকগণ মুদ্রা জারি করতেন। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড় বিজয়ের স্মরণে সেনাপতি বখতিয়ার খলজী সুলতান মুহম্মদ বিন সামের নামে গৌড় থেকে মুদ্রা জারি করেন। এটিই ছিল বাংলায় জারিকৃত প্রথম মুসলিম মুদ্রা। বখতিয়ার খলজীর গৌড় বিজয়ের সময়কাল থেকে বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠার (১৩৩৮ খ্রি.) পূর্ব পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক ১৩০ বছর বাংলা দিল্লির সুলতানদের অধীন একটি প্রদেশ হিসেবে এবং পরবর্তী ২০০ বছর (১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রি.) স্বাধীন সুলতানি হিসেবে শাসিত হয়। বাংলার প্রাদেশিক গভর্নরগণ দিল্লি সালতানাতের মুদ্রার অনুকরণে বাংলা থেকে স্বীয় প্রভুদের নামে মুদ্রা জারি করেন। গভর্নরদের মধ্যে অন্তত চারজন স্ব-স্ব সুলতানদের সঙ্গে মুদ্রায় নিজের নাম উৎকীর্ণের অনুমোদন লাভ করেছিলেন। তাছাড়া কয়েকজন গভর্নর বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সকলেরই স্বনামে উৎকীর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা লাভকারী এদের কয়েকজন সুলতান ব্যতীত সবারই বিভিন্ন ধরনের এবং ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের প্রচুর রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। সাধারণত বাংলায় তিন প্রকার ধাতুর মুদ্রার কথা জানা যায়-  স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র। বেশ কয়েকজন সুলতানের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। তবে প্রত্যেক সুলতানের রৌপ্যমুদ্রা ছিল। তাম্রমুদ্রার প্রাপ্তি অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক, কারণ প্রাচীনকাল থেকেই ছোটখাটো লেনদেনে বাংলায় কড়ির ব্যবহার প্রচলিত ছিল।


বাংলার টাকশাল থেকে জারিকৃত এ যাবৎ ঘোরের একজন ও দিল্লির ছয়জন সুলতানের নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। প্রাদেশিক গভর্নরগণই এ মুদ্রা জারি করতেন। যাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে তারা হলেন- মুইজউদ্দীন মুহম্মদ বিন সাম (১২০৩-১২০৬ খ্রি.), সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (১২১০-১২৩৬ খ্রি.), সুলতান জালালউদ্দীন রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি.), সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.), সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.), সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক (১৩২০-১৩২৫ খ্রি.) এবং সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রি.)। এদের মধ্যে মুহম্মদ বিন সাম ও ইলতুৎমিশ স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা জারি করেন। বাকি সবারই রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। একমাত্র মুহম্মদ বিন তুঘলকের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা পাওয়া গেছে।


মোট চারজন গভর্নর বাংলায় নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করেন- ১. আলীমর্দান খলজী ২. মুগীসউদ্দীন ইউযবক ৩. মুইজুদ্দীন তুগরল ৪. নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (বুগরা খান)। তাছাড়া ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্বে আরও কয়েকজন স্বাধীন সুলতান মুদ্রা জারি করেন। তারা কোনো সময় গভর্নর ছিলেন না, সরাসরি স্বাধীন ক্ষমতা অর্জন করেন। তারা হলেন-  ১. গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী ২. রুকনুদ্দীন কায়কাউস ৩. শামসুদ্দীন ফিরুজ ও ৪. গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর। এছাড়া শামসুদ্দীনের তিন পুত্র তার জীবদ্দশাতেই স্ব-স্ব নামে মুদ্রা প্রচলনের অধিকার পেয়েছিলেন। পুত্রদের মুদ্রায় তাদের পিতাও যে সুলতান ছিলেন সে বিষয়টি নামের শেষে ‘সুলতান বিন সুলতান’ (সুলতানের পুত্র সুলতান) বাক্য যোগ করে বুঝানো হয়েছে।


বাংলার সুলতানি শাসকগণ মুদ্রাকে জনগণের জন্য সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে টাকশালের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেন। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রশাসনিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাকশাল স্থাপন করে সেখান থেকে তারা মুদ্রা প্রকাশ করেন। সুলতানি আমলের ২৭টিরও বেশি টাকশালের নাম পাওয়া যায়। এগুলোর সব পৃথক পৃথক স্থানে ছিল এমন নয়। সুলতানগণ কখনও কখনও নিজের নামে অথবা পিতার নামে রাজধানী শহরের নামকরণ করেছেন এবং সেই নাম মুদ্রায় উৎকীর্ণ করেছেন। যা হোক টাকশালের নামের পূর্বে বিভিন্ন ধরনের বিশেষণ- হজরত জালাল, ইকলিম, খিত্তা, আরসাহ প্রভৃতি ব্যবহার করা হতো এবং সাল তারিখ সংখ্যার পরিবর্তে কথায় উৎকীর্ণ হতো। গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের মুদ্রায় প্রথম সাল তারিখের ক্ষেত্রে সংখ্যার ব্যবহার দেখা যায়। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ মুদ্রার প্রান্তে লিপি উৎকীর্ণের ধারা তুলে দেন এবং টাকশালের নাম ও তারিখ সংখ্যায় মুদ্রালিপির সঙ্গে বৃত্তের মধ্যে স্থান পেতে থাকে। এই সময় থেকে টাকশালের নামের পূর্বে বিশেষণের ব্যবহার লুপ্ত হয় এবং মুদ্রার প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্করণ মোটিফের ব্যবহার মুদ্রার শোভা বর্ধন করতে থাকে। সাধারণভাবে বাংলার সুলতানদের ২৭টি টাকশালের নাম পাওয়া যায়।  এগুলো হচ্ছে- ১. লাখনৌতি ২. ফিরুজাবাদ ৩. সাতগাঁও ৪. সোনারগাঁও ৫. মুয়াজ্জমাবাদ ৬. শহর-ই-নও ৭. গিয়াসপুর ৮. ফতেহাবাদ ৯. খলিফাতাবাদ ১০. হোসেনাবাদ ১১. মুজাফ্ফরাবাদ ১২. মাহমুদাবাদ ১৩. মুহম্মদাবাদ ১৪. আরাকান ১৫. তান্ডা ১৬. রোটাসপুর ১৭. জান্নাতাবাদ ১৮. নুসরাতাবাদ ১৯. চাওয়ালিস্তান ওরফে কামরু ২০. বারবকাবাদ ২১. পান্ডুনগর ২২. সুবর্ণগ্রাম ২৩. চাটিগ্রাম ২৪. চন্দ্রাবাদ ২৫. খলিফাতাবাদ বদরপুর ২৬. বঙ্গ এবং ২৭. শরিফাতাবাদ।


সংখ্যায় ২৭টি টাকশালের নাম থাকলেও সবগুলোর পৃথক সত্তা ছিল না। কারণ অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলার সুলতানগণও সময় বিশেষে রাজধানী অথবা টাকশাল শহরের নাম পরিবর্তন করতেন। ওপরের টাকশালগুলো বিশ্লেষণ করলে নামগুলোকে নতুনভাবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- রোটাসপুর নামের পাঠ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জান্নাতাবাদ নামটি গৌড়ের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। শহর-ই-নও, হোসেনাবাদ, নুসরাতাবাদ ও মাহমুদাবাদ গৌড়েরই পরিবর্তিত রূপ। আরাকান কোনো শহর নয় বরং বাংলার সীমান্ত অঞ্চল। পান্ডুনগর পান্ডুয়ার সঙ্গে অভিন্ন, আর চট্টগ্রামের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে চাটিগ্রামকে। এই ১১টি নাম একীভূত করলে মোট টাকশাল শহরের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টি।


মুসলিম শাসকদের মধ্যে গিয়াস উদ্দীন তুঘলকের ছেলে মুহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন কিছুটা ভিন্ন চিন্তা-চেতনার। তিনি প্রায় ২৫ ধরনের মুদ্রা চালু করেছিলেন। তার টাকশাল ছিল ৯টি। নির্মিত মুদ্রাগুলোর ক্যালিগ্রাফি ছিল চমৎকার। তবে তার কিছু খেয়ালীপনাও ছিল। সিংহাসন দখল নিয়ে পিতাকে হত্যা করে তিনিই আবার মৃত বাবার নামে মুদ্রা চালু করেছিলেন। তার আমলে মুদ্রার ওজন নিয়ে টুকটাক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়। তামার মুদ্রা চালু করে তিনি বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন। তামার মুদ্রা নকল হয়ে যায় পাইকারী হারে। বাধ্য হয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে বাজার থেকে আসল-নকল সকল তামার মুদ্রা কিনে তা তুলে দেন।


পরবর্তীকালে মোগল আমলে বিভিন্ন দেশীয় বংশের শাসনকালে বিভিন্ন রকম মুদ্রার প্রচলন ঘটে। ক্রমে ক্রমে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের বণিক গোষ্ঠী (পর্তুগিজ, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফরাসি, ইংরেজ) এ অঞ্চলে আগমন করে স্বীয় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নতুন নতুন মুদ্রা বাজারে ছাড়তে থাকে। এ সময় দেশীয় মুদ্রার ঘরানাগুলোও ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও ব্রিটিশদের মুদ্রা এ অঞ্চলে অনেক দিন টিকে ছিল। পরবর্তীকালে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ দেশীয় মুদ্রা চালু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশি টাকা ও মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নামটি মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে গাজীপুরে দেশের প্রথম ও একমাত্র আধুনিক টাকশাল স্থাপিত হয়।

লেখক : কবি-সাহিত্যিক, সমালোচক


সর্বশেষ সংবাদ