দুঃস্বপ্ন: শারমিন আক্তার সাথী (পর্ব-২)
রিদি মনে মনে ভাবছে, সকালে দেখা এই হিজিবিজি অদ্ভুত অগোছালো স্বপ্ন আবার সত্যি হবে নাতো? ওর বর্ণ সারা জীবন ওর কাছে থাকবে তো? নাকি এই দুঃস্বপ্নের মত দুর্বিষহ হবে রিদি আর বর্ণের জীবন। মনটা ভীষন অস্থির লাগছে ওর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ফজরের আযান দিতে এখনও সময় আছে। তাই নিজের অস্থিরতা কাটাতে ওযু করে চার রাকাত তাহাজ্জুত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো। নিজের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করলো।
কিছুক্ষন পর ফজরের আযান দিলো। রিদি নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করলো বেশ খানিক সময়। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৫:১৭ বাজে। রিদি ভাবল, নাহ্ এখন আর ঘুমাবো না। তার থেকে বরং দাদি আর নানির কাছে গিয়ে গল্প করি।
২।।
বিয়ে বাড়ি বলে ইতোমধ্যে অনেক লোক উঠে কাজে লেগে পড়ছে। বিশেষ করে রান্নার লোক। বিয়ের রান্না করা শুরু হয়ে গেছে। রিদির বাবা (রহমান চৌধূরী) ইতিমধ্যে সব পর্যবেক্ষন করছে। আর ওর মা রান্না ঘরে নাস্তার জোগাড় করছে বোধ হয়। কেউ কেউ বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় এতাল বেতাল হয়ে ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুম দেখে রিদির খুব হাসি পাচ্ছে।
৩।।
রিদির ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনে দেখলো বর্ণের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করে বলল, আসসালামু আলাইকুম। কয়েক ঘন্টা পর হবেন আমার হবু হ্যাজবেন্ড।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। তা হবু ম্যাডাম আপনি কি আপনাদের বাড়ির পেছনের বাগানে আসবেন?
কেন স্যার?
আমি দাড়িয়ে আছি।
বর্ণের এমন কথায় রিদি মোটেও বিচলিত হলো না। কারন এমন উদ্ভট কাজ বর্ণ এর আগেও অনেকবার করছে। তাই রিদি ফোনটা কেটে চারদিক তাকিয়ে চুপি চুপি বাড়ির পিছনের বাগানে গিয়ে দেখে বর্ণ ওর দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে দুষ্টমি হাসি দিচ্ছে।
আজ রিদি কোন ভনিতা না করে নিজে থেকেই বর্ণকে জড়িয়ে ধরলো।
বর্ণ দুষ্টমি হাসি দিয়ে বলল, আজ মেঘ না চাইতেই যে বৃষ্টি। তাও প্রবল বেগে! ঘটনা কী রিদু ম্যাডাম!
রাতে ভীষন বাজে একটা স্বপ্ন দেখছি। তাই ভয় করছিল।
ওহ তা কী স্বপ্ন?
রিদি স্বপ্নের কথাটা বলতেই শুনে বর্ণ হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা। রিদি কপোট রাগ দেখিয়ে বলল, একদম হাসবে নাতো। গা জ্বলছে।
হা হা হা আচ্ছা সরি রিদু। আসলে তুমি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসো তাই আমাকে নিয়ে সবসময় টেনশন করো। তাই আমাকে হারানোর ভয়টাও তোমার বেশি। আর তাছাড়া মনে হয় গত কাল রাতে ঐ প্যাচ লাগানো স্টার জলসার বা জি বাংলার সিরিয়াল দেখছিলে তাই না।
চুপ করো তো। আমি মরছি আমার জ্বালায় আর ওনি মজা নিচ্ছে।
আচ্ছা একটা কথা বলো স্বপ্নে দেখা ইরি মেয়েটা কি খুব সুন্দরী ছিলো! তাহলে একটু চান্স নিতাম আরকি। (দুষ্টমি করে)
আই উইল কিল ইউ, বর্ণ।
বর্ণ হাসি দিয়ে বলল, এমনিতে তোমার ভালোবাসায় মরে আছি আর কত মারবে।
রিদি মুখ গোমরা করে অন্য দিকে ঘুরল। বর্ণ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, স্যরি।
রিদি মুখ গোমরা করে বলল ঠিক আছে। কিছুক্ষন পর রিদি জিজ্ঞেস করল, ভালো কথা তুমি এত সকালে এখানে কী করছো? এখন পর্যন্ত তো ছয়টাও বাজেনি।
কাল রাতে তুমি যখন কল দিছিলা তখন তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিলো তোমায়। তাই ফজরের নামাজ পড়ে চুপি চুপি তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। এখন যাবো, কয়েকঘন্টা পর বর বেশে আসছি। তারপর তোমায় বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে তোমার রাতের দুঃস্বপ্নকে রঙিন স্বপ্নে পরিনত করে দিবো।
যাহ পাজি! (লজ্জা পেয়ে)
ওদের দুজনকে কথা বলা অবস্থায় রিদির কাজিনরা ধরে ফেললো। একজন বলল, দুলাভাই মাত্র কয়েকঘন্টা পর বোনটাকে নিয়েই যাবেন। এখন আবার দেখা করার কী আছে!
বর্ণ লজ্জায় চুপ করে আছে। রিদি ওর কাজিনদের ধমক দিয়ে বলল, বেশি পাকামি কথা বলবি না। বর্ণ তুমি তো ওদের নাম জানোই, ও নেহা, ও মিতু, আর ও ইরি।
বর্ণ ইরির দিকে একপলক তাকিয়ে রিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, এই কি সেই স্বপ্নের ইরি!
রিদি লজ্জা পেয়ে বলল হ্যাঁ।
বর্ণ রিদিকে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বলল, দেখতে তোমার মত এত স্নিগ্ধ না, তবে খারাপ না। ফিটনেস একেবারে হট যাকে বলে। রিদি অগ্নি চোখে বর্ণের দিকে তাকাল।
বর্ণ হাসি দিয়ে বলল, কুল কুল, ডিয়ার। আই এ্যাম জাস্ট কিডিং। ইউ আর মাই প্রিন্সেস। তা প্রিন্সেস ওকে জড়িয়ে আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখার মানে কি? আমি তো ওকে ঠিকভাবে চিনিও না। একদিন মাত্র কথা হয়েছিলো, দু চার মিনিটের জন্য।
স্বপ্নের কথা আমি কী করে জানবো! আর ওকে না চেনাই ভালো। ওভার স্মার্ট মেয়ে। ওর সাথে যদি কথা বলতে দেখি না তোমায়, বিয়ের আগেই তোমায় শেষ করে দিবো।
বর্ণ মৃদু হেসে বলল, রিদু সোনা এটা তোমার অবচেতন মনের ভয়। সবসময় আমাকে সন্দেহ করো, আমাকে নিয়ে পজেসিভ থাকো তাই। আর ইরিকে তুমি এমনিও পছন্দ করো না। তো গত পরশু যখন আমি ইরির সাথে হেসে দু মিনিট কথা বলছি সেটা তোমার মস্তিষ্কে গেঁথে রয়েছে তাই তো ওমন স্বপ্ন দেখলে। আমরা স্বপ্নে আসলে সেটাই দেখি যেটা সারাদিন ভাবি, কিন্তু কাউকে বলতে না পেরে মনের মাঝে চেপে রাখি। তখন গিয়ে আমরা ওমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখি। বুঝলে?
হুম।
গুড গার্ল। ওকে রিদু। এখন যাই তবে। বাড়ি অনেক কাজ আছে।
বর্ণ রিদির কাজিনদের থেকে বিদায় নিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
দুপুরবেলা ঢাক ঢোল পিটিয়ে বর বেশে বর্ণ আসল। নতুন বরের সবাই যেমন দুষ্টুমি করে, বিশেষ করে শালীরা। ঠিক তেমনি রিদির কাজিনরা, বোনরা বর্ণের সাথে দুষ্টমি করছে। বিয়ে কাজ শেষ হবার পর যখন বর বধূকে এক জায়গায় বসানো হলো তখন ইরি, নেহা বর্ণের সাথে খুব দুষ্টমি করছিলো। বিষয়টা রিদির কাছে বিরক্তিকর লাগছে। তাই তো বর্ণের কোমরে গুতো দিয়ে চোখ রাঙিয়ে থামতে বলল।
রিদির অতিরিক্ত পজেসিভ হবার বিষয়ে বর্ণ খুব ভয় পায়। মেয়েটা যে ওকে পাগলের মত ভালোবাসে তা বর্ণ জানে। কিন্তু ওর এই অতিরিক্ত পজেসিভনেস যে পরবর্তীতে ওদের সম্পর্কে আঘাত করতে পারে সেটা রিদি বুঝতে চায় না। বর্ণ সবসময় রিদির সামনে সাবধানে চলে। নিজের মেয়ে বন্ধু, কাজিন সবার সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে রিদির কথা ভেবে। কারন বর্ণ চায়না রিদি সামান্য কষ্ট পাক। খুব ভালোবাসে যে ও রিদিকে। তাই তো ওর সব চাওয়া অকপটে হাসি মুখে মেনে নেয়। কিন্তু রিদির অতিরিক্ত পজেসিভ হওয়ায় সবসময় বেশ ভয় থাকে বর্ণ। কারন বর্ণ জানে যারা অতিরিক্ত পজেসিভ তাদের মনে অতিরিক্ত সন্দেহ জন্মে। আর কোন সম্পর্কে সন্দেহ নামক ব্যধি একবার ঢুকে গেলে সে সম্পর্ককে একদম শেষ করে তবেই শান্ত হয়। বর্ণ রোজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাতে রিদি আর ও সারা জীবন সুন্দর ভাবে একসাথে থাকতে পারে।
বিয়ের সব আয়োজন খুব সুন্দর সুষ্ঠ ভাবেই সম্পন্ন হলো। শুরু হলো রিদি বর্ণের জীবনের নতুন অধ্যায়।
৪।।
দেখতে দেখতে বিয়ের ছয় মাস কেটে গেলো। ছয়টা মাস ভালোবাসা, মান অভিমান আর খুনশুটি মিলে খুব সুন্দর ছিলো। বর্ণ আর রিদি ঠিক স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণের অক্ষরগুলোর মত। একজন আরেকজনকে ছাড়া শব্দ তৈরী করতে পারে না। রিদি তার দুঃস্বপ্নের কথা একদম ভুলে গেলো। বর্ণের ভালোবাসা আর সাপোর্টের কাছে দুঃস্বপ্ন গুলো মিথ্যা প্রমাণিত হলো। সংসার জীবন সুন্দরভাবে কাটাচ্ছে দুজন।
আজ রিদির ছোট বোন রিমি আর কাজিন ইরি আসলো বর্ণের বাসায় বেড়াতে। রিদি বরাবরই বর্ণকে নিয়ে পজেসিভ টাইপের। আর ইরি খোলা মেলা, ওপেন মাইন্ডেড মেয়ে। ইরির খোলামেলা চালচলন রিদির মোটেও পছন্দ না।
ইরি বর্ণকে দেখেই একরকম জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যালো দুলাভাই কেমন আছেন?
বর্ণ দ্রুত ইরিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বর্ণ জানে বিষয়টা রিদি ভালোভাবে নিবে না। তারপর দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলল।
রাতে খাবার সময় রিমি বলল, আপু ইরি আপুর ভার্সিটিতে সিট পেতে মাস খানিক সময় লাগবে। ততদিন ইরিআপু তোমার এখানে থাকবে। তোমাদের কোন অসুবিধা হবে নাতো?
রিদি ইরির মুখের উপর সরাসরি নাও বলতে পারছে না। কারন ওর চাচা ওকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু রিদি ইরিকে একদম পছন্দ করে না। কোন উপায় না পেয়ে ইরিকে থাকতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বর্ণও রিদির কথায় আপত্তি করল না।
বর্ণের বাসায় শুধু রিদি আর বর্ণ থাকে। বর্ণের বাবা মা গ্রামে থাকে। জবের খাতিরে বর্ণ রিদিকে নিয়ে শহরে থাকে। ওর বাবা মাকে এখানে থাকতে বললেও রাজি হয় না। মাঝে মাঝে এসে কদিন থেকে যায়। রিদি নিজেও জব করে। রোজ সকালে দুজন একসাথে অফিসে যায়। কখনো একসাথে বাসায় ফিরে আবার কখনো কাজের কারনে দুজন আলাদাভাবে বাসায় ফিরে। পরের দিন রিমি ইরিকে রেখে বাড়ি চলে যায়।
সপ্তাহ খানিক আগের নিয়মেই চলল।
কিন্তু আজ রিদি অফিস থেকে ফিরে এসে দেখল…
চলবে…
গল্পের কাহিনী ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।