সর্বস্তরে বাংলা: ৬৬ বছরেও হলো না, হবে তো?
উদ্যোগ আছে, প্রতিফলন নেই! সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু নিয়ে সামগ্রিক চিত্র এটাই। সরকারসহ অন্যন্য মহল বিভিন্ন সময়ে বাংলাকে সর্বস্তরে রূপ দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে হাজির হলেও ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার দাপট এখনো সর্বত্র। ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পার হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। বরং দিন দিন অবহেলা আর উপেক্ষার পাত্র হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। শুধু তাই নয়, সংবিধান স্বীকৃত হলেও দোকানপাটের নাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইনবোর্ড, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, আদালতের রায়, বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত কিংবা কোনও কিছুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও চলে ইংরেজির খবরদারিত্ব
বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ও কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী জানান, ভাষা আন্দোলন হলো প্রথম মুক্তিযুদ্ধ। এর ফল হলো- মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন। দুঃখজনক হলেও সত্য সে অধিকার আজ নিজেরাই নষ্ট করছি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও আন্তরিকতা থাকলে বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লিখেন, যতটুকু বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে মান প্রশ্নবিদ্ধ। এর জন্য অবশ্য দায়ী সরকারি উদ্যোগ। তার ভাষ্য, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা, বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় শিক্ষাদান করা হয়। কিন্তু সেই বাংলার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চশিক্ষার স্তরে মানসম্পন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তক এখনো নেই। কিন্তু অবশ্যই উচ্চশিক্ষার স্তরে গুণগত মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক থাকা দরকার ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে ২০১৪ ও সালে পৃথক দুটি আদেশে বেতার ও দূরদর্শনে বিকৃত উচ্চারণ, ভাষা ব্যঙ্গ ও দূষণ করে অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেয়া হয়। রুলে বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে কেন পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ ও বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা নির্ধারণ করতে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করতে বলা হয়। পরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়। কমিটি ওই বছরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়। তবে সেই সুপারিশ এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
তথ্যমতে, ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রয়োগ করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ এবং বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বানানরীতি’ প্রণয়ন করে। কিন্তু জাতীয় ভাষানীতি না থাকায় বানানে সমতা আনা যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানার অনেক প্রতিষ্ঠান প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করছে না। এ ভাষানীতির অভাবেই ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরকারের এক আদেশে ও ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিপরিষদের সভাসহ বিভিন্ন সরকারের আমলে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি।
মায়ের ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের বিক্ষোভ
জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের প্রয়োগ না থাকা অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বেশির ভাগ স্তরেই বাংলা বিমুখতা প্রকট আকার ধারণ করে। এর প্রেক্ষিতে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাইকোর্ট থেকে রুলসহ দুটি আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ভাষার সম্মান ও মর্যাদা অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন ভাষাবিদরা।
তারা বলছেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে দাবি ছিল তা আজও পূরণ হয়নি। শুধু কাগজে কলমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বত্রই ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার দাপট। এ অবস্থা চলতে থাকলে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যেতে পারে। ভাষা শহীদদের চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি।
ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ যাতে বৃথা না যায় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার চালু করতে হবে। প্রথমে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে অন্যরাও এতে উৎসাহিত হয়। শহীদ ভাষা সৈনিকদের উত্তরসূরী হিসেবে গোটা জাতির দায়িত্ব হচ্ছে মাতৃভাষাকে রক্ষা করা। এত বছর পরও সমাজ ও রাষ্ট্রের সব জায়গায় বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর স্বদিচ্ছার অভাব ছিল বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যপক সৌমিত্র শেখর বলেন, মাতৃভাষার প্রতি আন্তরিকতা থাকলে এমন হতো না। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারসহ সকল নাগরিককে সচেতন হতে হবে। বাংলাকে অবজ্ঞা করে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অতি উৎসাহ একটি মানসিক দাসত্ব। এ দাসত্ব থেকে সবাইকে বের হয়ে মাতৃভাষা ও শহীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আর অনুচ্ছেদ ২৩-এ বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন?’
১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’
নির্দিষ্ট আইন থাকার পরও দেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় উচ্চ আদালত থেকে রুলসহ দুটি আদেশ দেয়া হয়। ২০১২ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্যটি ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে রুলসহ আদেশ দেন আদালত। তবে প্রথম আদেশের ৭ ও দ্বিতীয় আদেশের ৫ বছর পার হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। রিটে বলা হয়, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ৩ ধারা অনুসারে সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে (বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত) চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সাওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। শুনানি নিয়ে আদালত ১৭ ফেব্রুয়ারি রুল জারির পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। কিন্তু আদালতের সে নির্দেশ মানা হচ্ছে না।
ভাষা আন্দোলনকে চেতনা ধরেই শুরু হয়েছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা
কিন্তু উচ্চ আদালতেই এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার উপেক্ষিত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলস এখনো ইংরেজিতে রয়েছে। আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নিয়ে আদেশ দিয়ে জারি করা একটি রুল পাঁচ বছর হলেও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের নামও ইংরেজিতে রাখা হচ্ছে।
কয়েকজন বিচারপতি ব্যক্তিগত আগ্রহে বাংলায় মাঝে মধ্যে রায় দিলেও এর সংখ্যা খুবই কম। সম্প্রতি নদী দখল নিয়ে হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। আর এর পুরোটাই দেয়া হয়েছে বাংলায়। যা গণমাধ্যমও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। পর্যায়ক্রমে সব কোর্টেই বাংলায় রায় হবে এমনটা প্রত্যাশা বিচারপ্রার্থীসহ সব মহলের।
আইনজ্ঞরা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার ব্যবহার সময়ের দাবি। তাদের মতে, বাংলা ভাষায় উচ্চ আদালতের রায় হলে বিচারপ্রার্থীদের জন্য অনেক সুবিধা হবে। সাধারণ মানুষও চান সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার। বিশেষ করে আদালতের ভাষা বাংলা হলে ভোগান্তি কমবে অনেকাংশেই। কারণ নিজে আদালতের আদেশ এবং রায় বুঝতে পারলে আইনজীবীর পেছনে কম সময় ব্যয় করতে হবে। আর মামলাও নিষ্পত্তি হবে দ্রম্নত।
এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, যদি এমন কোন সফটওয়্যার পাওয়া যায়, যাতে বাংলা মুখে বললে এটি সঙ্গে সঙ্গে টাইপ হয়ে যায় তাহলে বাংলায় রায় দেয়া সুবিধা হবে। অবশ্য এখন এ সফটওয়্যার রয়েছে। অনেকেই তা মোবাইলে তা ব্যবহারও করছেন।