১৫ নভেম্বর ২০১৮, ২১:৫৪

সুফি-বাউলিয়ানা ছুঁয়ে মধ্য ইউরোপের সুরে মাতোয়ারা

ফোক ফেস্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করছেন শিল্পীরা  © টিডিসি ফটো

ঢাকার শ্রোতার শুনতে পেলেন মধ্য ইউরোপের সুর। পোল্যান্ডের খ্যাতিমান লোকগানের দলটি কুর্দি, বেলারুস, ইসরায়েল অঞ্চলের সুরকে তুলে ধরলেন বাংলাদেশের শ্রোতাদের সামনে। ভারতের পাঞ্জাবের ওয়াদালি ব্রাদার্স সুফি ঘরানার গানে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার অনুভূতি ছড়িয়ে দিলেন। এমনি করেই বাংলার লোক গানের সঙ্গে ইউরোপ ও পারস্যের মেলবন্ধন ঘটলো ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে ফোক ফেস্টের চতুর্থ আসরে।  

প্রকৃতি থেকেই লোক সঙ্গীতের উৎপত্তি। বিস্তীর্ণ চরাচর, ধূ ধূ মাঠ, ফসলের খেত, রাঙা ধুলোয় মোড়া মেঠো পথের পরতে পরতে মিশে আছে বাংলার গান। মিশে আছে এই বাংলার মানুষের মনে। শুধু বাংলা কেন পৃথিবীর সব দেশেই লোক সঙ্গীত মাটি থেকে উৎসারিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকগানকে এক সুঁতোয় বেঁধেছে আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত উৎসব। সান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে চতুর্থবারের মত আয়োজিত এ উৎসবে বাংলাদেশসহ সাত দেশের দেড়শতাধিক শিল্পী অংশ নিচ্ছেন। 

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে শনিবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হয়ে এ উৎসব চলবে রাত বারোটা পর্যন্ত। 

মানুষের দৈনন্দিন জীবন, কাজের ব্যস্ততা, অবসর ও নির্জনতার অনুভূতি মিশে আছে বাংলার গানে। আর্মি স্টেডিয়ামে হেমন্তের কুয়াশার মাঝে লোক সঙ্গীতের আসরে মানুষ যেন নিজের শেকড়ের গানের টানে ছুটে এসেছিলেন। যে গান আমাদের অস্তিত্বে মিশে রয়েছে। সেই লোক গানকে নিয়ে এই বিশাল আয়োজনে মানুষ দর্শক-শ্রোতারা এসেছিলেন দল বেঁধে।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোক নাচের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব। ভাবনা নৃত্যদল পরিবেশন করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণিল নাচের উপস্থাপনা বর্ণময় করে তোলে উৎসব মঞ্চ। ‘সোহাগ চাঁদ বদনি ধনী নাচ তো দেখি’ এ গানের সঙ্গে নৃত্য দিয়ে শুরু করে শিল্পীরা। এরপরে পাহাড়ি নৃত্য, রাঁয়বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। সামিনা হোসেন প্রিমার পরিচালনায় নৃত্যদল ভাবনার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ আসর। সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ ও সান কমিউনিকেশনের আয়োজনে মেরিল নিবেদিত এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, গ্রামীণফোন ও রাঁধুনী।

লোকসঙ্গীত সমকাল থেকে অনুপ্রাণিত হয় কিন্তু তাকে অনুসরণ করে না। লোকসঙ্গীতের উপমা, বর্ণনার ভঙ্গি সবসময় আধুনিক। সে কারণেই এ গান বহতা নদীর মত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে। আসরের প্রথম দিনের দ্বিতীয় শিল্পী হিসেবে সুর তোলেন মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ানের শিষ্য নারায়নগঞ্জের আবদুল হাই দেওয়ান। গুরু তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘হাফ মাতাল’ এই উপাধি নিয়েই গানে গানে মানুষের মন রাঙিয়ে তুলছেন তিনি। গতকালও বাউল গানে মাতালেন উৎসব মঞ্চ। তিনি গেয়ে শোনান ‘মা গো মা - জি গো জি/ পড়লাম কি রঙ্গে/ ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে’, ‘তুই বড় রঙ্গিলা বাওয়াইরে, বাওয়াই কতই জাদু জানো’, ‘বাজার ভাল না গো বন্ধু, বাজার ভাল না’, ‘কোন বা দেশে রইলা দয়াল’, ‘বন্ধু রে তোর জ্বালায় বাঁচি না’ ও তোমারও লাগিয়া রে বন্ধু’। 

এরপরে ছিল সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এতে অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী, ঢাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, গ্রামীনফোনের চিফ বিজনেস অফিসার মাহমুদ হোসেন। 

প্রথম দিনেই পোল্যান্ডের লোকগানের দল দিকান্দা প্রথমবারের বাংলাদেশে পরিবেশনায় অংশ নেয়। বলকান এবং জিপসির প্রভাব থাকা মধ্য ইউরোপের এ দলটি গানের তাল আর লয়ের দিয়ে বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। দিকান্দা ব্যান্ডটি তাদের প্রতিটি গানের শব্দের মাঝে তৈরি করে নিজস্ব লোকজ শব্দ যা সবার কাছে ‘দিকান্দিশ’ নামে পরিচিত। এ ব্যান্ডের শিল্পীরা হলেন গায়িকা আনিয়া উইটযাক ও কাসিয়া বগুশ, পারকাশন বাজিয়েছেন দানিয়েল কাচমারজিয়েক, ক্লাসিক্যাল গিটার বাজিয়েছেন পিওত্র রেইদাক, ডাবল বেসে ছিলেন জেগরজশ কলব্রেচকি, ট্রাম্পেট বাজান সিমন বব্রস্কি আর ভায়োলিনে ছিলেন আন্দ্রে ফিস ইয়ারজাবেক। 

এরপর আসেন কোক স্টুডিওতে লালন গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শিল্পী ভারতের সাত্যকী ব্যানার্জী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশে এসেও পৌছেছে তার জনপ্রিয়তার রেশ।

ভারতের পাঞ্জাবের ওয়াদালি ব্রাদার্স সুফি ঘরানার এক ভিন্ন পরিবারের সদস্য। বংশের পঞ্চম পুরুষ হিসেবে ওস্তাদ পূরণচন্দ্র ওয়াদালি ও পেয়ারেলাল ওয়াদালি ভ্রাতৃদ্বয় ভারতের সুফি সঙ্গীতে সমাদৃত। পেয়ারেলাল ওয়াদালি এ বছরের ৮ মার্চ মারা যাওয়ার পরও দলটির নাম পরিবর্তন হয়নি। তার বদলে দলে যোগ দিয়েছেন পূরণচন্দ্র ওয়াদালির ছেলে লক্ষ্মিণদার ওয়াদালি। গান তাদের কাছে শুধু সুরের সাধনা নয় বরং ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার মাধ্যম। তাই গানে গানে ঈশ^রের সন্ধান করেন শিল্পীরা। সেই নিবেদন ফুটে উঠলো শিল্পীদের গানে। গতকালকের সর্বশেষ পরিবেশনায় মঞ্চে এসে শিল্পীর বুল্লে শাহ্, ফরিদ সাহেব, শাহ্ হুসেইন জি’র ভজন গেয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছেন। তার পরিবেশনার মধ্য দিয়েই প্রথম দিনের আয়োজন শেষ হয়।

শুক্রবারের উৎসবসূচি

শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা উপস্থাপন করবে লোকগানে বাংলার অহংকার মমতাজ বেগম এবং লোকগানের দল স্বরব্যঞ্জন । এদিন আরো গাইবেন ভারতের দ্য রঘু দিক্ষিত প্রজেক্ট, যুক্তরাষ্ট্রের লস টেক্সমেনিয়াক্স এবং বাহরাইনের মাজাজ।

শনিবার শেষ ও তৃতীয় দিনে অংশ নেবেন পাকিস্তানের শাফকাত আমানত আলী, স্পেনের লাস মিগাজ এবং বাংলাদেশের বাউল কবির শাহ, অর্নব ও নকশীকাঁথা।

বরাবরের মতো এবারও ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব সরাসরি সম্প্রচার করছে মাছরাঙা টেলিভিশন। এছাড়াও গ্রামীণফোনের অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস ‘বায়োস্কোপ লাইভ’-এ অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখার সুযোগ থাকছে। এবারের উৎসবের পেমেন্ট পার্টনার বিকাশ, লজিস্টিক পার্টনার বেঙ্গল ডিজিটাল, রেডিও পার্টনার রেডিও দিনরাত, পিআর পার্টনার মিডিয়াকম, মেডিকেল পার্টনার স্কয়ার হসপিটালস্ লিমিটেড, সিকিউরিটি পার্টনার এইজিস সিকিউরিটি ফোর্স, হসপিটালিটি পার্টনার ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন, ঢাকা এবং রেজিস্ট্রেশন পার্টনার সহজ ডটকম।