ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলো সাবেক আইজিপি মামুনকে
জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। মামলার প্রধান অভিযুক্তরা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, যারা পলাতক রয়েছেন।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) বেলা ১১টার পর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেলে রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিকে, সোমবার সকালে ৯টা ১০ মিনিটের পর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এ মামলায় আজই শেষবারের মতো তাকে হাজির করা হচ্ছে। যদিও হাসিনা ও কামাল পলাতক, সাবেক আইজিপি দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে ছিলেন। তিনি রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন, ফলে প্রসিকিউশন সাবেক এই আইজিপির শাস্তি ট্রাইব্যুনালের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। পাশাপাশি, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা চাওয়ার আবেদনও করা হয়েছে।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আদালত এই মামলার রায়ের দিন ঠিক করেন। গণ-অভ্যুত্থানে পতন হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে থাকুক না কেন, যদি কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। আগামীকাল আদালত তার সুবিবেচনা অনুযায়ী রায় ঘোষণা করবেন। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেছি এবং আশা করি, আদালত সঠিক ও দৃষ্টান্তমূলক রায় দেবেন।’
অন্যদিকে আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন জানান, ‘মক্কেলদের অনুপস্থিতিতেও আমি তাদের সর্বোচ্চ যুক্তি উপস্থাপন করেছি। আশা করছি, ট্রাইব্যুনাল তাদের খালাস দিবে। বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা বা অসুবিধা হয়নি এবং প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ আমাদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় গত ১৭ অক্টোবর। সেদিনই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
চলতি বছরের ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে মামলায় আসামি করার আবেদন করেন প্রসিকিউশন, যা ট্রাইব্যুনাল অনুমোদন করে। তদন্ত সংস্থা ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রসিকিউশন ১ জুন শেখ হাসিনা ও দুই আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের ভাগ্য নির্ধারণ আজ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলোতে উল্লেখ রয়েছে, ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়া, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ দেওয়া, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর নির্দেশ। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। একই দিন ট্রাইব্যুনাল-১ আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’সহ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
শেখ হাসিনা অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারের সহায়তায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষ নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনটি জনগণের জন্য বিজয়ের দিন হলেও পুলিশের বর্বর হামলার কারণে এটি মর্মান্তিক দিন হিসেবেও পরিগণিত।
শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। আসাদুজ্জামান খান কামালও ভারতে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হয়। মামলার একমাত্র কারাগারে থাকা আসামি সাবেক আইজিপি মামুন ১০ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধে দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। এরপর আদালত তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে অনুমোদন দেন।
মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ২৩ অক্টোবর। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন দুই আসামির খালাসের আবেদন জানান। রাজসাক্ষী মামুনের পক্ষেও খালাসের আবেদন করা হয়েছে। আগামীকাল রায় ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।