০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩:১৪

৪ আগস্ট : ফেনীর মহিপালে গুলিতে একসঙ্গে প্রাণ হারান সাত তরুণ

আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ৭ তরুণ  © ফাইল ফটো

গত বছরের ৪ আগস্ট দুপুরে ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভার এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয় ছাত্র-জনতা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগানে মুখরিত ছিল গোটা এলাকা, হৃদয়ে লাল-সবুজের স্বপ্ন। আন্দোলনে অনেকেই জাতীয় পতাকা বুকে ও মাথায় জড়িয়ে যুক্ত হন। হঠাৎ দুপুরের এক সময়ে শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ—একটির পর একটি প্রাণ থেমে যায় ঘাতকের বুলেটে।

আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, মো. সরোয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী, জাকির হোসেন শাকিব ও ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম। পরদিন ৭ আগস্ট বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারও মৃত্যু হয়।

হামলার পর একে একে মরদেহ এসে পৌঁছায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের সামনের মেঝেতে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল মরদেহগুলো। আহতরা যখন শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য যান, তখন সেখানেও হামলা ও চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মরদেহ ‘গুম’ করার গুজবে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল ঘিরে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল এলাকা। অনেকেই বলেন, স্বাধীনতার পর এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য আর কখনও দেখেননি।

সেদিন উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল মায়ের ওড়না পেঁচিয়ে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও একমাত্র সন্তানের স্মৃতি ভুলতে পারেননি মা ফাতেমা আক্তার শিউলি। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্টের পর থেকে আমাদের গোছানো জীবন পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বড় মেয়েটি এখনো শ্রাবণের শোকে নিঃশব্দে কাঁদে। আমার সব আনন্দ, আশা, ভালোবাসা ছিল আমার ছেলের সঙ্গে। তার হত্যাকারীদের বিচার আজও হয়নি। আমি বিচার চাই।’

শ্রাবণের মতোই ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান ওয়াকিল আহমেদ সিহাব। তার মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘৪ আগস্ট সকালে ও বাড়ি এসেছিল। বলেছিলাম চুল কেটে আসতে। হয়তো বুঝে গিয়েছিল, এটাই আমাদের শেষ দেখা। তিনটি গুলি ওর বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।’

শহীদ সরোয়ার জাহান মাসুদের মা বিবি কুলসুম বলেন, ‘ওকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। মুখটাও দেখতে দেয়নি ৫ মিনিট। বুকটা খালি করে দিয়ে গেছে।’

ছাইদুল ইসলাম শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার জন্য আমার কাছে ২৫ টাকা ভাড়া চায়। আমার কাছে না থাকায় বাবার কাছ থেকে নিয়ে যায়। বলেছিল, ফেনী যাওয়া-আসার জন্য টাকাটা দরকার। কিন্তু আর ফেরা হয়নি। ঘাতকরা ওকে মেরে ফেলেছে।’

নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুমের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মামলার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে যায়। কোর্টের পিপি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে জামিন পায় অনেকে। এটা আমাদের জন্য বড় কষ্টের।’

সেদিন আহতদের মধ্যে ছিলেন ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নূর হোসেন। তিনি বলেন, ‘পায়ে গুলিবিদ্ধ হই। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে পারিনি। হাসপাতালে গেলেই আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করত। চিকিৎসা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও নিষেধ করত তারা। ঘটনার দুই দিন পর চিকিৎসা নিয়েছি।’

ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, “আমাদের ভাইয়েরা যে উদ্দেশ্যে জীবন দিয়েছে তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই সরকারের উচিত ছিল ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সরকার উদাসীন। আমরা দাবি জানাই, মৌলিক সংস্কার ও শহীদদের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা হোক।”

আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় ফেনীতে দায়ের করা হয়েছে ২২টি মামলা—এর মধ্যে ৭টি হত্যা এবং ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। ফেনী মডেল থানায় করা এসব মামলায় এজাহারভুক্ত ২ হাজার ১৯৯ জন ও অজ্ঞাত ৪ হাজার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন,  ‘মোট এক হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কলেজ শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী এবং ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।’

তিনি আরও বলেন, ‘মৃতদের পরিবারের জন্য আমাদের কাছে সান্ত্বনার ভাষা নেই। তদন্ত চলছে। দেশের বাইরে থাকা আসামিদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে দেশে থাকা আসামিদের তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। চার্জশিটে রাজনৈতিক পরিচয় নয়, কেবল সম্পৃক্ততা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।’

ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফেনীতে আন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা এবং পুনর্বাসনে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে সাড়ে ৫ কোটির বেশি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শহীদদের আত্মত্যাগ কখনো অবমূল্যায়ন করা হবে না। তাদের স্মরণে যথাযথ মূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে।’