শহীদ আবু সাঈদের ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের দিন আজ
বুক তার যেন খোলা আকাশ, চিত্ত ছিল ভয়শূন্য। খোলা তলোয়ারের মতো ছড়িয়ে দেওয়া দুহাত হয়ে উঠেছিল মুক্তির প্রতীক। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের এক নতুন স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন আবু সাঈদ যার সেই দুই হাত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। তিনি জানতেন, যে কোনো মুহূর্তে ছুটে আসতে পারে বুলেট, বিদ্ধ করতে পারে তার বুক। তবুও নিষ্পেষণ আর রাষ্ট্রীয় জাঁতাকল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে, অগাধ সাহসে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজপথে, দুই হাত তুলে।
না বুঝে নয় পুরোপুরি জেনেশুনেই সব ধরনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদে নেমেছিলেন তিনি। আওয়ামী সরকারের দোসররা যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তখন ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদকে টার্গেট করেই গুলি চালানো হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রথমে স্থবির, তারপরই লুটিয়ে পড়েন পিচঢালা সড়কে। সেদিনই জন্ম নেয় ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’। আর আবু সাঈদ হয়ে যান এই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ।
আজ সেই ১৬ জুলাই, আবু সাঈদ হত্যার প্রথম বার্ষিকী। দিনটি ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রংপুরসহ দেশজুড়ে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেলে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হলে তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক হিসেবে নেতৃত্বে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ। পুলিশের ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে, আবু সাঈদ বুক পেতে দুই হাত মেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তার উল্টো পাশে মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে দুই পুলিশ সদস্য সরাসরি শটগান থেকে তার দিকেই গুলি চালান।
আরও পড়ুন: পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ: ১৬ জুলাইয়ে কোটা আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে
এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ফুঁসে ওঠে ক্ষোভ। ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে সেদিন আরও দুইজন নিহত হন—একজন বলাকা সিনেমা হলের সামনে অস্থায়ী দোকানের হকার মো. শাহজাহান (২৪), অপরজন নীলফামারীর বাসিন্দা বাদশা আলী ও সূর্য বানুর ছেলে সাবুজ আলী (২৫)।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৩০ জুন অভিযোগ আমলে নেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসে। পলাতক ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার থাকা রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ আপেলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাজির করার নির্দেশও দেওয়া হয়।
আবু সাঈদ শুধু একজন আন্দোলনকারী ছিলেন না—তিনি ছিলেন প্রতিবাদের নতুন ভাষা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা মকবুল হোসেন ও মাতা মনোয়ারা বেগমের নয় সন্তানের মধ্যে কেবল আবু সাঈদেরই পড়াশোনার সুযোগ হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে আবু সাঈদকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বীরশ্রেষ্ঠ’ আখ্যা দেন। তিনি লিখেন, ‘ফরেনসিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট—এক. পুলিশ টার্গেট করে প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করেছে; দুই. হাসপাতালে নিতে দেরি হয়নি, এমনভাবে গুলি করা হয়েছিল যে বাঁচার সম্ভাবনাই ছিল না। আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—আবু সাঈদ জেনেশুনেই খুন হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।’
অন্যদিকে, হাইকোর্ট থেকে রুল জারি করে জানতে চাওয়া হয়েছে, কেন আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ ও ওয়াসিমসহ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে প্রাণ হারানোদের ‘জাতীয় শহীদ’ ঘোষণা করা হবে না।