১৫ জুলাই ২০২৫, ১৪:০৪

১৫ জুলাই : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলা, ছাত্রীদের মারধর

ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলায় নারী শিক্ষার্থীসহ আহত অনেক  © ফাইল ফটো

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই (সোমবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দিনভর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই আহত হন অন্তত ২৯৭ শিক্ষার্থী। যাদের সবাইকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া সারাদেশে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন অন্তত চার শতাধিক শিক্ষার্থী।

ছাত্রলীগের এই সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সন্ধ্যায় আহতদের চিকিৎসা চলাকালেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে হামলা চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, আবাসিক হল, এমনকি হাসপাতালও এদিন আন্দোলনকারীদের জন্য নিরাপদ ছিল না।

এর পেছনে ছিল আগের দিন, ১৪ জুলাই বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া এক বক্তব্য। সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে? এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সেদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। স্লোগান ওঠে— ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’

এর পরদিন ১৫ জুলাই ধানমন্ডিতে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তার আত্মস্বীকৃত রাজাকার, গত রাতে নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এর জবাব ছাত্রলীগই দেবে।’ একই সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘রাজাকার বলে যারা স্লোগান দিয়েছে, তাদের শেষ দেখে ছাড়ব।’ এরপরই সারাদেশে শুরু হয় সঙ্ঘবদ্ধ হামলা।

আরও পড়ুন: উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে স্তব্ধ ৮ জনের সংসার

বেলা ১২টার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার অধিভুক্ত সাত কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ হলপাড়ার দিকে মিছিল নিয়ে গেলে বিজয় একাত্তর হলের সামনে প্রথম সংঘর্ষের সূচনা হয়। মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশের হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রড, হকিস্টিক, রামদাসহ অস্ত্র নিয়ে মল চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বর এলাকায় আশ্রয় নিলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠলেও সেখানে ঢুকে হামলা চালানো হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, মহানগর ছাত্রলীগ ও সাত কলেজ শাখা ছাত্রলীগ এই হামলায় অংশ নেয়। আহত হয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। আক্রান্ত হন নারী শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকেরাও।

শুধু ক্যাম্পাসেই নয়, সন্ধ্যায় আহত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বার্ন ইনস্টিটিউটেও। একই সময়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নিয়েও হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ সহযোগিতা তো করেনি, বরং নীরব ছিল।’

আরও পড়ুন: ‘বাবা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না’— মেয়ের চিঠি পড়া হল না শহীদ রিয়াজুলের

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল প্রাধ্যক্ষদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য প্রাধ্যক্ষরা রাতভর হলে অবস্থান করবেন।’ সন্ধ্যার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

ক্যাম্পাসে সহিংসতার পাশাপাশি রাতে আবাসিক হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় আরেক দফা নিপীড়ন। রাত ১০টার পর স্যার এ এফ রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মোবাইল ফোন তল্লাশি শুরু করে। আন্দোলনে সম্পৃক্ততা পেলে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়।

ইডেন কলেজে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যাওয়ার পথ আটকে দেয় কলেজ ছাত্রলীগ। গেটে তালা দিয়ে তাদের আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে বিক্ষোভে অংশ নেন।

এদিকে পুরান ঢাকা থেকে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাবি ক্যাম্পাসে এসে বিক্ষোভে যোগ দেন। এর আগে জবিতে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনভর বিক্ষোভের মধ্যে ছাত্রলীগের দফায় দফায় হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। এর আগের রাতে শতাধিক বহিরাগত নিয়ে শাখা ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। অনেকেই উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন: মায়ের স্বপ্নভঙ্গ: গ্রামে মাকে নিয়ে আর ফেরা হলো না শহীদ জামাল উদ্দিনের

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দুবার হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শহীদ মিনার ও কাটাপাহাড় সড়কে হামলায় আহত হন ১০ জন। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে আহত হন আরও অনেকে, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যরাও রেহাই পাননি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। যশোর এম এম কলেজে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলাকারীদের বিচার দাবিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের কাছে স্মারকলিপি দেন।

একই দিনে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড ও নতুনবাজার এলাকায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। একইসঙ্গে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটেও বিক্ষোভ-মিছিল ও সমাবেশ হয়।

সরকারি প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের স্লোগান ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’–কে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘রাজাকারের পক্ষে স্লোগান রাষ্ট্রবিরোধী। এটি সরকারবিরোধী নয়, রাষ্ট্রবিরোধী।’ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘এ যুগের রাজাকারদের পরিণতি হবে ওই যুগের রাজাকারদের মতোই।’

এই সহিংসতার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) বিকেল ৩টায় সারাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। রাত সাড়ে ৯টায় দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। তার এমন বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেই হবে।’