ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত গনি মিয়া
১৯ জুলাই ২০২৪। ঢাকার মহাখালীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের চাউলিয়া গ্রামের গনি মিয়া (৩৮)। পেটের দায়ে ছয় মাস আগে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। নাখালপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন, আর দিনভর রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যায় ফিরতেন ঘরে।
সেই সন্ধ্যায় আর ফেরা হলো না গনির। রিকশার গ্যারেজে গাড়ি রেখে মহাখালী থেকে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন, কিন্তু সেখানে চিকিৎসক ছিলেন না। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন গনি মিয়া।
গনি মিয়া ছিলেন ছামছুল হক ও মৃত এফাতন নেছার ছেলে। পরিবারের অভাব দূর করতে রিকশা চালানো শুরু করেছিলেন। ঢাকায় থাকতেন, সেখান থেকেই প্রতিসপ্তাহে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে চালাতেন গ্রামের বাড়ির সংসার।
আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিছে—আমি তার ফাঁসি চাই’
স্ত্রী সবুজা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী রিকশা চালাইয়া সংসার চালাইতো। আমাদের তিনটা ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে কলেজে পড়ে, ছোট এক ছেলে আর এক মেয়ে। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। যেন আর কোনো সংসার এমনভাবে ভেঙে না যায়।’
গনির বড় ভাই হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ঐদিন পথচারীরা তাকে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসক ছিল না। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মরদেহ বাড়িতে আনতেও আমাদের টাকা ছিল না। মানুষজনের কাছে হাত পেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া মেটাতে হয়েছে।’
গনির সংগ্রামী জীবন ছিল কঠিন। চালকলে কাজ করতেন একসময়, পরে সেই আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হওয়ায় ঢাকায় যান। সেই রিকশার টাকায় চলতো তার পাঁচ সদস্যের পরিবার।
আরও পড়ুন: ‘শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’—স্লোগান দিতে গিয়েই শহীদ হন জাহিদ
বড় ছেলে শহীদুল ইসলাম (১৭) বলেন, ‘আমার বাবা নাই এক বছর। আমাদের পরিবারের বটগাছ ছিলো বাবা। তাকে হারিয়ে আমরা ভেঙে পড়েছিলাম। তবে অনেকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লক্ষ, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লক্ষ, জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লক্ষ টাকা, বিএনপি থেকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।