আটকে পড়াদের উদ্ধারে গিয়ে নিজের প্রাণই দিলেন আলামিন
আলমিন হোসেন, বয়স মাত্র ২৮। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চাকরি নিয়েছিলেন রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ভেটেরিনারি বিভাগে। যশোরের চৌগাছা উপজেলার আফরা গ্রামের সন্তান তিনি। অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসার চালাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন দূর বরগুনার আমতলি উপজেলার একটি মেসে।
বাবা আনোয়ার হোসেন একজন হৃদরোগী, মা আশুরা বেগম ডায়াবেটিকস রোগী। তিন ভাইয়ের মধ্যে আলামিনই বড়, আর সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যও। সংসারে চার শতক ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই। বৃষ্টি হলে সেই ঘরেই পানি উঠে, রান্না বন্ধ থাকে। সেই ভাঙা ঘরে আলামিনের পাঠানো টাকায় চলত মায়ের ইনসুলিন, বাবার ওষুধ, ছোট ভাই মুবাশিরের পড়াশোনা।
আরও পড়ুন: বেঁচে থাকলে তারাও আজ এইচএসসি পরীক্ষায় বসত
আর এখন? কেবল নিস্তব্ধতা। কেবল দীর্ঘশ্বাস। আর বারবার উচ্চারিত একটিই কথা, ‘ভাইয়া তো শুধু আমাদের না, এলাকারও আশা ছিল।’ আলামিন ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু সাম্য ও ন্যায্যতার জন্য যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের জুলাইয়ে, তাতে তার অবস্থান ছিল অটল। তিনি ছিলেন এই প্রজন্মের এক আত্মমর্যাদাশীল কণ্ঠ।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বরগুনার আমতলি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। শহরের মেয়রের বাড়িতে আগুন লাগলে সেখানে অনেকে আটকা পড়ে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সেই আগুন থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন আলামিন। অগ্নিকুণ্ড থেকে জীবিত উদ্ধার হলেও—পুড়ে গিয়েছিল তার সমস্ত শরীর।
বার্ন ইনস্টিটিউটে ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর ১৮ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে নিভে যায় আলামিনের জীবনপ্রদীপ। নিভে যায় আফরা গ্রামের বাতিঘর। গ্রামের মানুষ সেই দিনটিকে বলেন—‘আমাগো আলামিনের সলিল সমাধি’।
ছেলের কথা উঠতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আশুরা বেগম। বলেন, ‘রাত এলে ঘুম আসে না। কান্না আসে। ছেলেটা আমাকে ফোন দিত, মা খাইছো? আব্বার ওষুধ নিছো? এখন তো ফোনই বাজে না... আমি জানি না কেমনে বাঁচমু।’
আরও পড়ুন: জুলাই আন্দোলন শুরু যে কর্মসূচি দিয়ে
তিনি বলেন, ‘ছেলেটা আগুনে পুইড়া মরা, আমি কিছুই করতে পারলাম না। এক ঘণ্টা আগেও ফোনে কথা বললো, বললো—মা, সাবধানে থাকো। তারপরই খবর আসলো, ওরে আগুন খাইয়া নিছে।’
বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওইদিন সকালেও বলছিলাম, বাবা বাইরে যাস না। কিন্তু আমার ছেলে তো মানুষ বাঁচাতে গেছিল। সেই আগুনে জ্বইরা গ্যাছে আমার কলিজার টুকরা। এখন কারে ধরি, কাহারে বলি? কেবল আল্লাহর দরবারে বলি, যারা এই আন্দোলনের ছেলে-মেয়েদের গুলি চালায়, পুড়ায়, তাদের বিচার যেন আল্লাহ করেন।’
আলমিনের ছোট ভাই মুবাশির বলেন, ‘আমার ভাইয়া আমার সব কিছু ছিল। ওর পাঠানো টাকায় পড়াশোনা করতাম, এখন কীভাবে চলব জানি না। ভাইয়া বলতো, তুই একদিন বিসিএস দিবি। ভাইয়া নিজে স্বপ্ন দেখতো, আমিও দেখতাম। এখন সেই স্বপ্ন ছাই হয়ে গেছে।’
১৮ আগস্ট বিকেলে যখন আলামিনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়, তখন আকাশ যেন ভার হয়ে আসে। জানাজায় শুধু আফরা গ্রামের মানুষ নয়, আশপাশের তিন গ্রাম থেকে মানুষ ভিড় করেন। তরুণেরা কাঁধে তুলে নেয় শহীদের লাশ। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শত শত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়— ‘আলমিন ভাইয়ের রক্ত বৃথা যাবে না।’
আরও পড়ুন: গেজেটে নাম নেই ২৩ জুলাই শহীদের, অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় পরিবার
আলামিনের পরিবার জেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ এবং ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছে। কিন্তু মা-বাবা চান শুধু টাকা নয়, চাই তার স্বীকৃতি।
আশুরা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়া মরছে। ওরে শহীদ ঘোষণা করুক। যাতে আর কোনো মা চোখের সামনে ছেলেকে আগুনে পুড়তে না দেখে।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।