০১ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৮

‘বাবারে একবার বল, মা খাইছো—এইটুকু শুনি’ : ছেলের খোঁজে মা

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মুখলেছুর রহমান  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকার রাজপথে ন্যায্যতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো মানুষদের একজন হলেন জামালপুরের হিরন্যবাড়ী গ্রামের ছেলে মুখলেছুর রহমান। বয়স মাত্র ২৪। বাবা-মায়ের একরাশ স্বপ্ন আর নিজের বুকভরা প্রত্যয় নিয়ে যে তরুণ এসেছিলেন শহরে—তিনি আর জীবিত ফিরে যাননি। ১৭ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২০ জুলাই সকালে টঙ্গীর তুরাগ নদীতে পাওয়া যায় তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ।

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে জন্ম হয়েছিল একটি কাঁচা মাটির ঘরে। সরিষাবাড়ী উপজেলার হিরন্যবাড়ী গ্রামের দিনমজুর হাবিবুর রহমান আর গৃহিণী মরিয়ম বেগমের ঘরে। অভাব-অনটনের সংসারেও মা-বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে মানুষ হোক। মুখলেছুরও ছোটবেলা থেকেই বুঝেছিল, এই ঘরটাকে একদিন পাকা করে তুলতে হবে।

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়েছেন মুখলেছুর। এরপর হাতে তুলে নেন সংসারের হাল। কখনো বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ, কখনো স্থানীয় বাসে হেলপার, আবার কখনো রাজমিস্ত্রির জোগালি। অভাব তাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি দায়িত্ববোধ। সেভেনে পড়তেই বুঝে গিয়েছিলেন, নিজের জন্য নয়—বাঁচতে হবে পুরো পরিবারের জন্য।

আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম— আইল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া’

মাত্র ১৮ বছর বয়সে মাত্র ৪০০ টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান মুখলেছুর। প্রথমে একটি গ্যারেজে কাজ শিখে পরে হয়ে ওঠেন দক্ষ চালক। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস চালিয়ে রুটিন করে টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। মা বলেন, ছেলেটা প্রতিদিন রাতে ফোন দিত, শুধু জিজ্ঞেস করতো—মা, খাইছো তো?

২০২৪ সালের জুলাইয়ে যখন সারাদেশে ছাত্র-জনতা নেমে আসে বৈষম্য ও মেধা হত্যার বিরুদ্ধে, মুখলেছুর ছিলেন একজন সচেতন পথচারী। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না কখনোই, কিন্তু প্রতিদিন রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে শুনতেন মানুষের ক্ষোভ। অনিয়মের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে তার অন্যরকম মনে হয়েছিল।

১৭ জুলাই, বুধবার—এক বন্ধুর ডাকে গিয়েছিলেন আজমপুর। সেখানকার শান্তিপূর্ণ মিছিলের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রদের। হঠাৎই পুলিশ আসে, ছত্রভঙ্গ করে দিতে শুরু করে মিছিল। প্রথমে টিয়ারশেল, পরে গুলি।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়, ‘ও ভাই তো গাড়ি চালাতো। দাঁড়ায়া ছিলো রাস্তার একপাশে। দেখি এক গুলি লাগে, পড়ে যায়। এরপর মানুষ ছুটতে থাকে, ভাইটা আর ওঠে না।’

তারপর নিখোঁজ। ১৭ জুলাই বিকেলে মুখলেছুরের সঙ্গে আর কোনোভাবে যোগাযোগ করা যায়নি। মরিয়ম বেগম তখন জামালপুরে। ছেলের ফোন বন্ধ, খোঁজ নেই কোথাও। প্রতিদিন ফোন করতেন, কান্নায় ভেঙে পড়তেন—‘বাবারে একবার বল, মা খাইছো—এইটুকু শুনি।

আরও পড়ুন: ‘আশা ছিল ছেলেকে সাদা অ্যাপ্রোনে দেখব, দেখলাম সাদা কাফনে’

২০ জুলাই সকালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে স্থানীয় জেলেরা ভেসে থাকা এক দেহ দেখতে পান। পুলিশের সহায়তায় দেহটি উদ্ধার করা হয়। শরীরে স্পষ্ট গুলির চিহ্ন, কিছু অংশ বিকৃত। পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে সনাক্ত করেন—এটা মুখলেছুর রহমান।

ভাই তখন বলে ওঠেন, ‘আমার ভাইরে মাইরা ফালাইছে। সে তো কোনো রাজনীতি করতো না। ও তো গরিবের পোলা ছিলো!’

২১ জুলাই সকালে হিরন্যবাড়ী গ্রামে পৌঁছায় তার লাশ। শত শত মানুষ ভিড় করে তাকে শেষবার দেখার জন্য। মাটির সেই ঘরে ফিরলেন ঠিকই মুখলেছুর, তবে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো নিথর দেহ হয়ে।

শোকে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মা মরিয়ম বেগম শুধু বলে উঠলেন, ‘আমি শুধু আল্লাহরে বলবো—আমার মুখলেছুররে যারা মাইরা ফেলছে, তুমি বিচার কইরা দাও। আমি কারো কাছে বিচার চাই না, আল্লাহর কাছে চাই।’

ছেলেটি একদিন বলেছিলেন—‘আমি একদিন মা-বাবারে গাড়িতে করে হজে নিবো।’ কিন্তু হজ তো দূরের কথা, তার গাড়িটাই আর চালানো হলো না। সমাজের এক কোণায় জন্ম নেওয়া এক তরুণ, যার জীবনে ছিল পরিশ্রম আর স্বপ্ন—সে আজ শহীদের কাতারে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।