৩০ জুন ২০২৫, ১২:০৮

‘আশা ছিল ছেলেকে সাদা অ্যাপ্রোনে দেখব, দেখলাম সাদা কাফনে’

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ জিল্লুর শেখ  © টিডিসি সম্পাদিত

মাত্র তিন দিন আগে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার ইম্পেরিয়াল কলেজে। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন, মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবেন। সেই স্বপ্নের শুরুটা হয়নি ভালোভাবে, কিন্তু শেষটা হলো রক্তে ভেজা রাজপথে, গুলির বৃষ্টিতে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ৫৯টি বুলেট থামিয়ে দিল শহীদ জিল্লুর শেখের জীবন।

গত বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বিকাল ১টা ৪০ মিনিটে নাগরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার শরীরে লাগা গুলির সংখ্যা গণনার সময় চিকিৎসকরাও থমকে যান—একটি-দুটি নয়, ৫৯টি গুলি বিধে ছিল এই তরুণের শরীরে।

আরও পড়ুন: পুলিশের বুলেটে মুহূর্তেই ঝাঁঝরা আকতারের দেহ, দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা আকলিমা

জিল্লুর শেখের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠি গ্রামে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার বাড্ডার নূরের চালা বোর্ড গার্ড এলাকায়। এসএসসি পাস করেছেন বনশ্রীর ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুল থেকে। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবা হাসান শেখ ছেলের কলেজে ভর্তির খবর পেয়েই বলেছিলেন, ‘এইবার আমার ছেলেকে সাদা অ্যাপ্রনে দেখব। কিন্তু সেই ছেলেকে দেখলাম সাদা কাফনে’ আমার সেই স্বপ্ন আজ শুধুই কান্নার শব্দ হয়ে ফিরে আসে।

১৮ জুলাই সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবা ফোন করে বলেন, ‘জিল্লুর, নামাজ পড়ে নিস।’ সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে তার শেষ কথা। এরপর যা ফিরেছে, তা নিথর এক দেহ—ছিন্নভিন্ন, গুলিবিদ্ধ।

চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন জিল্লুর। তার মৃত্যুর খবরে গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার চাচা রবিউল শেখ বলেন, ‘১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও দেখে জিল্লু তার মাকে বলেছিল—‘আমি দরকার হলে জীবন দেব।’ ওর কথাটা সত্যি হয়ে গেল এত তাড়াতাড়ি।’

আরও পড়ুন: বেঁচে থাকলে তারাও আজ এইচএসসি পরীক্ষায় বসত

গ্রামে এসএসসি পরীক্ষার পর কিছুদিন ছিলেন জিল্লুর। চাচার সঙ্গে মাছ ধরতেন, রোজা রাখতেন, গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন। চাচার চোখ ভিজে ওঠে—‘ও এখন আর ক্রিকেট খেলে না, খেলার মাঠে শুধু শূন্যতা।’

তার মৃত্যুর পর ঢাকার আনসার ক্যাম্পের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ জিল্লুর সড়ক’। ইম্পেরিয়াল কলেজের একটি ভবনও উৎসর্গ করা হয়েছে তার নামে। সরকার পরিবারটিকে একটি ফ্ল্যাট ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাবা হাসান শেখ বললেন, ‘আমি কি করব ফ্ল্যাট নিয়ে? আমার পুতের মতো স্বপ্ন তো আর কেউ ফেরত দিতে পারবে না।’

ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে থেমে যাচ্ছিলেন বাবা হাসান শেখ। বারবার চোখ মুছছিলেন, গলার স্বর কাঁপছিল। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জিল্লুর ছোটবেলা থেইকাই ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতো। আমি বলতাম, আল্লাহ চাইলে একদিন হইবি। কলেজে ভর্তি হইল, আমি ভাবলাম—স্বপ্নটা হয়তো এবার ধরা দিব। কিন্তু বই-খাতা কিনার আগেই লাশ হইয়া বাড়ি ফিরল। আমার ছেলের শরীরে ৫৯টা গুলি করছে। আমি কোনোদিন কারো ক্ষতি করিনি, আমার ছেলে রাজনীতি করত না। তাও ওরে মেরে ফেললো। আমি এই হত্যার বিচার চাই।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।