ক্যাডার হতেই হবে— এমন চিন্তা বিসিএসের অন্তরায়: পররাষ্ট্রে ৩য় নোভা
- রিফাত হক, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ১০:২০ AM , আপডেট: ২১ জুন ২০২২, ১১:১১ AM
তাহসিন বিনতে আনিস (নোভা)। ৪০তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে তৃতীয় হয়েছেন। তার জন্ম পাবনার বেড়া উপজেলায়। বাবা মো. আনিসুর রহমান ডাক্তার, মা নাসরিন বেগম শিক্ষক। ২০১০ সালে জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১২ সালে জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
ঢাবির রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও রোকেয়া বিতর্ক অঙ্গনের সাবেক সভাপতি ছিলেন নোভা। সম্প্রতি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, পরামর্শ ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি রিফাত হক-
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই...
তাহসিন বিনতে আনিস: আমার শৈশব কেটেছিল পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায়। বাবা ডাক্তার হওয়ায় থাকতাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে৷ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। বাবা-মার ইচ্ছায় ছোটবেলায় গান শেখা শুরু করি। সাইকেল চালাতে খুব ভালবাসতাম। সাইকেল চালালে মন হত পাখির মত উড়ছি আমি। এরপর ক্লাস সেভেনে চলে যাই ক্যাডেট কলেজে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কী?
তাহসিন বিনতে আনিস: এ ব্যাপারে আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি। আমার যেকোন সিদ্ধান্তে পরিবারের সবাইকে পাশে পেয়েছি। কোন সিদ্ধান্ত তাদের জন্য কঠিন মনে হলেও, তারা সব কিছুতেই আমাকে সমর্থন করেছেন। ডাক্তারে ঘেরা পরিবারে বড় হওয়ায় মেয়েকে ডাক্তারই হতে হবে, এরকম চাপ আমাকে দেয়া হয় নি। বরং আমি যেটা চাই, সেটাতেই সবাইকে পাশে পেয়েছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস ক্যাডার হতে কার বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন?
তাহসিন বিনতে আনিস: আমার কাছে মনে হয়, আমরা আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরিবারে, কিংবা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, বিসিএস সেই অভিজ্ঞতাগুলোরই একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া৷ ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের হাতেখড়ি হয় আমার বাবার কাছেই৷ ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাই। আমাকে "আমি" হিসেবে গড়ে তুলতে ক্যাডেট কলেজের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। বাবা, মা, ভাই, ভাবি, হাসবেন্ড প্রত্যেকটা মানুষের আমার প্রতি যে বিশ্বাস, সেটা আমার জন্য সব সময়ই অনুপ্রেরণা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
তাহসিন বিনতে আনিস: আমার জন্য প্রিলিমিনারি ধাপটাই সবচেয়ে কঠিন ছিল৷ এই ধাপটার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অনেক কমতি ছিল। তবে এই বিশ্বাস ছিল, প্রিলিমিনারি পাশ করতে পারলে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় ভাল করব। প্রস্তুতি কীভাবে নিব, কী করলে ভাল হয়, এগুলো অনেকের কাছেই শুনতাম, তবে সেটা নিজে প্রয়োগ করতে পারতাম না। আমার মনে হয়, প্রতিটি মানুষ আলাদা, প্রত্যেকের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার জায়গাও আলাদা। তাই নিজের স্ট্র্যাটিজি নিজেকেই ঠিক করতে হয়। আমিও সেটিই করেছি, সেজন্য পিএসসির যে নির্ধারিত সিলেবাস আছে, সিলেবাসটা আদ্যোপান্ত গবেষণা করে দেখেছি আমার কোন বিষয়গুলো নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হবে, আর কোন বিষয়গুলোতে সহজে ভাল করতে পারব। সেভাবেই নিজের স্ট্র্যাটিজি ঠিক করেছি। প্রস্তুতির জন্য "গুগল" ছিল আমার পরম বন্ধু। গুগল করেই বেশিরভাগ বিষয় বুঝে নিতাম।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে কেন এলেন?
তাহসিন বিনতে আনিস: ছোটবেলায় ভাবতাম খেলোয়াড় হব। বড় হতে হতে মাথায় ঢুকল "আইন" নিয়ে পড়ব। পরবর্তীতে আইন পড়ার সুযোগ না হওয়ায় ভেবেছিলাম সিভিল সার্ভিসের জন্য চেষ্টা করব। তবে এভাবে কখনো ভাবিনি যে বিসিএস ক্যাডারই হতে হবে আমাকে। যখন বিসিএস এর পছন্দক্রম ঠিক করি, তখন ভেবেছি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তো স্বপ্নের মত। সেই চিন্তা থেকেই পররাষ্ট্র প্রথম পছন্দ হিসেবে দেয়া।
আরও পড়ুন: ছাত্রনেতা থেকে পুলিশ ক্যাডার শাস্ত্রী
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ভাইভার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন?
তাহসিন বিনতে আনিস: ছোটবেলা থেকেই উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক করায় ভাইভার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ভাইভা ভাল-মন্দ মিলিয়েই হয়েছিল। তবে পুরোটা সময় মনে হয়েছে তারা আমার ব্যক্তিত্বটাই মূলত পরীক্ষা করছেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইংরেজিতে দক্ষতা বৃদ্ধি জন্য কী কী করেছেন?
তাহসিন বিনতে আনিস: যেকোন ভাষার দক্ষতা অর্জনই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। চর্চা ছাড়া হুট করে ভাল করা যায় না। স্পোকেন ভাল করতে ইংরেজিতে নিয়মিত কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। সেটা বন্ধুদের সাথে হোক, পরিবারের সাথে হোক, কিংবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হোক। ইংরেজি উপন্যাস, কবিতা, নিউজ পেপার, ভিডিও, সিনেমা, সিরিজ সব কিছুই সাহায্য করে নতুন শব্দ শিখতে। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা বাচনভঙ্গি ভাল করার গুরত্বও কম না, কিন্তু এই বিষয়টায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনযোগ দেয়া হয় না। আর ইংরেজি ব্যাকরণের ব্যাপারগুলো শুধু ফর্মূলা হিসেবে মুখস্থ না করে, এর সেন্সটা বুঝে যদি পড়া যায়, তাহলে ব্যাকরণ অনেক সহজ হয়ে যায়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি তো ডিবেটিং ক্লাবের যুক্ত ছিলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কী কী স্কিল থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
তাহসিন বিনতে আনিস: আমি বিশ্বাস করি যেকোন স্কিলই আমাদের নিজেদের "বেটার ভার্সান" বানাতে সাহায্য করে। সেটা সাঁতারও হতে পারে, সাইক্লিংও হতে পারে, আবার রান্নাবান্নাও হতে পারে। যেকোন কাজের সক্ষমতা অর্জনই প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়া খুব জরুরি। এমনকি বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোরও গুরূত্ব অনেক। বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হলে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন যারা বিসিএস দিতে চান বা বিসিএস এ ভালো করতে চান, তাদের জন্য পরামর্শ কী?
তাহসিন বিনতে আনিস: বিসিএস দিতে হলে অনেক পরিশ্রমী কএবং ধৈর্য্যশীল হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি রাখতেই হবে৷ এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত, সব সময়ই প্ল্যান 'বি', এমকমকি প্ল্যান 'সি'ও মাথায় রাখা উচিৎ। আমি তাই করেছিলাম। জীবনে প্ল্যান 'এ' কাজ নাও করতে পারে। আমাকে বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে, না হতে পারলে জীবন শেষ, এ ধরনের অহেতুক চাপ পরীক্ষায় ভাল করার পথে অন্তরায় এবং ডিপ্রেশানের কারণ হয়।
আরও পড়ুন: উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে বিসিএস প্রস্তুতি, ম্যাজিস্ট্রেট হলেন নওশীন
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
তাহসিন বিনতে আনিস: প্রতিবছরই ভাবি পরের বছর নিজের বেটার ভার্সান তৈরি করতে চাই। সেই চেষ্টাটা আজীবন অব্যাহত রাখতে চাই। সিভিল সার্ভিসের অংশ হওয়ার যে সুযোগ পেয়েছি, নিষ্ঠার সাথে সেটা পালন করার চেষ্টাটাই থাকবে সবচেয়ে বেশি। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা জীবনেরই অংশ, সব কিছুকেই মোকাবেলা করার শক্তি ধারণ করতে চাই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
তাহসিন বিনতে আনিস: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।