রাজনৈতিক গাফিলতির শিকার জনগণের আকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য পরিসেবা: তাজউদ্দিন শিকদার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক তাজউদ্দিন শিকদার। জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এনভায়রোনমেন্টাল সায়েন্স থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা এই শিক্ষকের আছে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যে পরিবেশ দূষণের প্রভাব নিয়ে সাতশ’র বেশি গবেষণা নিবন্ধ আছে তার। পরিবেশ নিরাময় খাতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। তাজউদ্দিন শিকদার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে আয়োজিত সিম্পোজিয়াম ও সেমিনারে অংশ নিয়েছেন।
মহামারিতে ভেঙ্গে পড়া দেশের জনস্বাস্থ্য নিয়ে গুণী এই শিক্ষক কথা বলেছেন সাংবাদিক বেলাল হোসেনের সঙ্গে।বেলাল হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।
বেলাল হোসেন: বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্র কি পর্যায়ে আছে?
তাজউদ্দিন শিকদার: মূলত অসংক্রামক ব্যাধির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত গড়ে উঠেছে। যার কারণে এধরনের মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশের অদক্ষতা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিলো। দেশে করোনা শনাক্তের ব্যাপ্তি এক বছরের বেশি। শুরুতে ভাইরাস প্রতিরোধে জনমানুষের শারীরিক ও মানসিক ভাব ইতিবাচক ছিল। এরপরেও স্বাস্থ্যসেবায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সরকারকে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে হয়। এর কারণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা।
বর্তমানের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২০ সালের অদ্ভুত সমস্যা থেকে আমরা মোটেও শিক্ষা নেইনি। করোনা মহামারীর এই অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্যখাত যখন সংক্রামক ব্যাধির ওপর জোর দিয়েছে, তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোন র্যাডিকাল পরিবর্তন হয়নি। মূলত রাজনৈতিক গাফিলতির শিকার হয়েছে জনগণের আকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য পরিসেবা।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্য কাঠামো ও ভ্যাক্সিন কর্মসূচী নিয়ে আপনার পর্যালোচনা কী?
তাজউদ্দিন শিকদার: ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচির জন্য একটি বিশেষায়িত কাঠামো প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান কাঠামোটিকে সংস্কারপূর্বক সে পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। এমনকি ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য পর্যাপ্ত জনশক্তি, মেধা ও সামর্থ্যও রয়েছে আমাদের। এজন্য গবেষণার ইতিবাচক পরিবেশ ও বরাদ্দ প্রয়োজন।
বেলাল হোসেন: কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গবেষণার জন্য ২০২০ সালের বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করার সামর্থ্য দেখাতে পারেনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
তাজউদ্দিন শিকদার: অধিদপ্তর নিজস্ব ব্যর্থতা ঢাকতে বলেছে পর্যাপ্ত জনবল নেই। বাংলাদেশের মেডিকেল সেক্টরে অনেক মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন। যারা ভাল মানের গবেষণা করার সামর্থ রাখে। তাদের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) পলিসির কারণে মূলত এ অর্থ একাডেমিশিয়ানদের মাঝে বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো স্বাস্থ্যসেবার জন্য কতটুকু সহায়ক?
তাজউদ্দিন শিকদার: বাংলাদেশের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে উপেক্ষিত খাত স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানী শহরে গড়ে উঠে গার্মেন্টস শিল্প কিংবা ইকোনমিক জোনের কথা।
বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো গড়ে তোলার সময় জনস্বাস্থ্য বিষয়টি পরিকল্পনার মধ্যেই থাকে না। এছাড়া বিশেষায়িত চিকিৎসা মুষ্টিমেয় কিছু শহরে কেন্দ্রীভূত। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো জনস্বাস্থ্য কাঠামোর সাথে বিপর্যয়পূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান রেখে চলেছে।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় জনস্বাস্থ্য বরাবরই উপেক্ষিত। বর্তমান পরিস্থিতি কি বাস্তবতা পরিবর্তনে সহায়ক হবে?
তাজউদ্দিন শিকদার: দেশে শতাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমার গবেষণায় এসেছে, মাত্র ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি বেসরকারি ও ৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তন্মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জনস্বাস্থ্য বিভাগ রয়েছে। বাদবাকি সব অপূর্ণ। এখানে অনার্স ও মাস্টার্স করা যায়।
এই ২২টি প্রতিষ্ঠান হতে বছরে মাত্র ৩০০জন জনস্বাস্থ্যবিদ তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ কার্যকরী। দেশের জনসংখ্যার সাথে এ সংখ্যার আনুপাতিক মান প্রহসনমূলক, যা এই মহামারি পরিস্থিতি দেখিয়েছে। এখান থেকে নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা নিলে তবেই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
বেলাল হোসেন: মহামারির এক বছর হলেও স্বাস্থ্য খাতের এখনও বেহাল দশা কেন?
তাজউদ্দিন শিকদার: কারণ, জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারকদের মনন ও মানসিকতায় জনস্বাস্থ্যের শিক্ষা বলে কিছু নেই। এমনকি এ বিষয়ে সরকারের আত্মোপলব্ধিও নিম্নমানের।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবাকে মুক্তবাজারের পণ্যের মতো বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত?
তাজউদ্দিন শিকদার: এ অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিন্যাসে পার্থক্য অনেক। এটা মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে সম্ভব হয়েছে। যা দেশের সামগ্রিক পদ্ধতিকে গ্রাস করেছে এবং ধীরে ধীরে তা এ পর্যায়ে এসেছে। স্বাস্থ্যসেবা এর বাইরে নয়। কিন্তু এ অবস্থারও পরিবর্তন সম্ভব। এজন্য অদক্ষ জনবলকে দক্ষ করতে হবে, ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল প্রশাসনে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে বসাতে হবে। এছাড়া বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে বাণিজ্যিক মনোভাব কমানোর জন্য সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে শক্ত নীতিমালার মাধ্যমে। তবেই আমূল পরিবর্তন সম্ভব।
স্বাস্থ্যসেবাকে মুক্তবাজারের থাবা থেকে রক্ষা করতে আরো কিছু কাজ করা যেতে পারে। যেমন- ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ এর প্রচলন, যে পদ্ধতিতে উন্নত দেশসমূহ প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে সে যোগ্যতা রয়েছে। এজন্য ন্যাশনাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে জাপান ও আমেরিকা অনুকরণীয়।
আরো একটি ব্যাপার হচ্ছে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মেডিকেল ফ্যাকাল্টিকে স্পেশালাইজড করা। যেখানে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলো জনসাধারণের মাঝে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম হবে। জাপানেও তাই হয়ে আসছে।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যকাঠামো নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে উচ্চতর গবেষণার অভাব। এর দায় কার?
তাজউদ্দিন শিকদার: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে গবেষণার বেশিরভাগ হয়েছে ক্লিনিক্যাল ডাক্তারদের দ্বারা, যেটা হওয়া উচিত ছিলো জনস্বাস্থ্যবিদদের তরফ থেকে। কিন্তু প্রকৃত জনস্বাস্থ্যবিদের অভাবে কাঠামোগত গবেষণা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কাঠামোর পূর্ণতার জন্য ক্লিনিক্যাল ডাক্তারের সাথে ‘জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডক্টর’ এর প্রয়োজন। ১৯৫০ সালের মেডিকেল রেভ্যুলেশন অনুসারে বিশ্বস্বাস্থ্য গড়ে উঠেছে। এ বিপ্লব চিকিৎসা সরঞ্জামাদির হলেও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ছিল না। তাই এ বিপ্লবকে পরিপূর্ণ করতে স্বাস্থ্যবিদদের উচ্চতর গবেষণায় যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই।
বেলাল হোসেন: জনস্বাস্থ্যে মানসিক স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে?
তাজউদ্দিন শিকদার: মানসিক স্বাস্থ্য সুস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানসিক সুস্থতাকে কেন্দ্র করেই শরীর ও মন ভাল থাকে। এই জ্ঞানটুকু বাংলাদেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষের মধ্যে নেই। বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবির মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের ভ্যারিয়েশন রয়েছে। ফলে এদেশের স্বাস্থ্যখাতে গ্রাহক শ্রেণীই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন নয়, কিংবা গুরুত্ব দিচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে সেটির গুরুত্ব আরো হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থা হতে উত্তরণ জরুরী।
বেলাল হোসেন: মহামারিতে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে মানসিক হতাশা ও বিষন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবুও এর মোকাবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এতে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
তাজউদ্দিন শিকদার: ঘরের মধ্যে দেড় বছর আবদ্ধ একটি দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী। তাদের স্বাভাবিক হতে সময়ের প্রয়োজন হবে। ব্যক্তিভেদে এই মানসিক প্রভাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরুপণ করতে হবে এবং অবস্থা অনুযায়ী সকলের কাউন্সেলিং করতে হবে। না হলে আত্মহত্যার যে প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে তা রোধ করা সামর্থ্যের বাইরে চলে যাবে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ছিলো এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া। এজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকারি মাধ্যমে একটি বিশেষ সেল প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এটা অবহেলার কোন সুযোগ নেই।
বেলাল হোসেন: মহামারিতে কোভিড এবং নন-কোভিড চিকিৎসা সংকট নিয়ে কি বলবেন?
তাজউদ্দিন শিকদার: গত এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলে এ সংকট তৈরি হতো না। এখনও সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হলে এ সংকট মোকাবেলা করা যাবে। জনগণ এখন আতঙ্কের মধ্যে থাকে, অসুস্থতার জন্যে হাসপাতালে যেতে। কারণ সেখানে রোগীকে ভালোভাবে অভ্যর্থনা করা হচ্ছে না।
বেলাল হোসেন: অবাধ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার বিশ্বস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি। করোনা মহামারি মেডিকেল কমিউনিটিকে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে সংযমী করেছে কী?
তাজউদ্দিন শিকদার: এটা অনেক আলোচিত বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলেছে, যত্রতত্র এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করোনা মহামারীর চেয়েও ভয়ংকর কিছু নিয়ে আসছে। মেডিকেল কমিউনিটি চেষ্টা করছে তবে প্রোপার সিস্টেমের অভাব রয়েছে। সিস্টেম ঠিক রাখলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে জাতিকে সংযমী করা যাবে। এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সচেতনতা প্রয়োজন। এন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স অবস্থা ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে ঘোর অমানিশা নিয়ে আসবে, যদি না মেডিকেল কমিউনিটি কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
বেলাল হোসেন: আপানাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
তাজউদ্দিন শিকদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।