সঠিক নদী ব্যবস্থাপনায় বন্যা ও খরা’র সমাধান নিহিত: অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ
বিশ্বায়নের চলমান সময়ে প্রযুক্তি উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। কিন্তু মুদ্রার অপর দিকে পৃথীবিতে বাড়ছে দূষণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, নদী দূষণ ও অব্যবস্থাপনা, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন। করোনা মহামারি এ সকল সমস্যার পরিণয়ের ফসল।
এ সমস্ত বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক এর সঙ্গে কথা বলেছেন বেলাল হোসেন।
অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ দূষণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সত্তরের অধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এজন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি মর্যাদাপূর্ণ তরুণ বিজ্ঞানী স্বর্ণপদক প্রদান করেন তাঁকে। অধ্যাপক তারেক যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কেমিক্যাল সোসাইটিতে ফেলো ও পরিবেশবিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বেলাল হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।
বেলাল হোসেন: সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। আপনি কী মনে করেন বর্তমান প্রজন্ম আগামীর শিশুদের কাছে পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে যেতে সক্ষম হবে। হলেও কতটুকু?
অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ: কাব্যে বিষয়টি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে ধরিত্রীর সংকট স্বীকার করে নেওয়া হয়। আমিও বলতে চাই বর্তমান পৃথীবি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কঠিন মসিবতে আপাতিত। আগামী প্রজন্ম নয়, বর্তমান প্রজন্ম মহামারি, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগের কবলে বসবাসের অনুপযোগী হয়েছে। এখান থেকে উদ্ধার পেতে হলে নিজকে সচেতন হতে হবে। এরপরেও বলতে চাই এখনো সুযোগ আছে, সবকিছুর সমাপ্তি হয়নি। নিজে বাঁচতে হবে, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও নির্মল ধরিত্রী উপহার দিতে হবে। এজন্য বিশ্বনের্তৃত্বকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। না হলে সর্বনাশের নেই বাকি।
বেলাল: এশিয়ার ৪৮টি দেশের মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি দেশে খরার প্রভাব রয়েছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিবেশবিদদের অভিমত কি?
শফি মুহাম্মদ: পরিবেশবিদরা বারংবার বলেছে নদী ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতাসীনদের কায়েমী স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। নদী, তাঁর প্রাকৃতিক নিয়মে চলতে চাই। নিয়ম উপেক্ষিত উন্নয়ন, ধ্বংস ছাড়া কিছুই ডেকে আনবে না। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও এখানকার খরা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে নদীর ব্যাপারে ভারসম্যপূর্ণ নীতিমালা করতে হবে। আভ্যন্তরীণভাবে নদী দখল থামাতে হবে। সঠিক নদী ব্যবস্থাপনায় বন্যা ও খরা’র সমাধান নিহিত আছে।
বেলাল: জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কতটা ভয়াবহ হুমকি? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কিভাবে কার্যকর।
শফি মুহাম্মদ: জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা উপলদ্ধি করাটাই প্রথম কাজ। তবেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় অঞ্চলের জলামগ্নতা বৃদ্ধিসহ আরো কিছু ব্যাপার সর্বজন স্বীকৃত। বাংলাদেশে এধরণের পরিবর্তনে অন্যতম ভুক্তভোগী দেশ। বাংলাদেশের সামুদ্রিক পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নানমুখী বিপদ বয়ে আনবে। যা ইতোমধ্যে নিরাপদ পানি সরবরাহে সংকট তৈরি করছে। এছাড়া সাগরের তীরবর্তী জেলাগুলো আক্রান্ত হচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগে। এমনকি ঝড়, জলোচ্ছাস বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক এই পরিবর্তন। এ ব্যাপারে যৌক্তিক পরিকল্পনা গৃহীত না হলে ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে দেশের জন্য। এখনই সময় সঠিক পদক্ষেপের।
বেলাল: বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় পরিবেশ সুন্দর রাখার ক্ষেত্রে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে৷ এরপরেও বাড়ছে না ব্যক্তি সচেতনতা। এ ব্যাপারে পরিবেশবিদ ও সরকার কিভাবে সমন্বিত ভূমিকা রাখতে পারে?
শফি মুহাম্মদ: প্রতিরোধের চেয়ে সচেতনতা জরুরী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আর্থ-সামাজিক দুর্বলতার কারণে সচেতনতায় কমতি দেখা যায়। এটা মোটেও কাম্য নয়। এতদসত্ত্বেও সরকার চেষ্টা করছে। তবে সেখানেও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। সমন্বিত ভূমিকার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যেগ। ঘাটতি এখানেই। পরিবেশ সংগঠন, সরকার ও একাডেমিশিয়ানরা চাইলেই এটার উত্তম সমাধান বের হবে। সামাজিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সাথে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ সম্পর্কিত বিশদ আলোচনা সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে।
বেলাল: পরিবেশকে নির্মল রাখতে গ্রামীণ পরিবেশের ওপর কি ধরণের গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শফি মুহাম্মদ: দেশের বৃহত্তম অংশ হিসেবে গ্রামীণ পরিবেশর গুরুত্ব অতুলনীয়। ধরিত্রীকে সুন্দর, নির্মল রাখতে এর বেশীরভাগ অংশে নজর দিতে হবে। আর সেটা হচ্ছে পল্লী ও গ্রাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের মহানগর পার্শবর্তী গ্রামগুলো আরবানাইজেশনের নিষ্ঠুর বলি হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ধ্বংস করছে পরিবেশ। সরকার, স্থানীয় প্রশাসকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে গ্রামীণ পুকুর, খাল-দিঘী দূষণের স্বীকার না হয়। এবং অবাধে সকল ধরনের পুষ্করিণী ভরাট বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ পরিবেশ সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে জনস্বাস্থ্যেও উন্নতি হবে।
বেলাল: সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য একটি সর্বজনীন সমাধান দরকার, যাতে দেশবাসী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
শফি মুহাম্মদ: সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় করে সেটা সম্ভব নয়। প্রকৃতির ওপর অবিচার সভ্যতাকে কঠিন প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন করবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে। না, হলে সেটি টেকসই হবে না। এজন্য প্রশাসনের মধ্যে পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বেলাল: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হলে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। সেই প্রয়াস বা প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহ কিভাবে গুরুত্ব পেতে পারে?
শফি মুহাম্মদ: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু সেটা কতটুকু বাস্তবসম্মত হচ্ছে সেটা দেখার ব্যাপার। আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ ও ভাষণের গুরুত্ব আছে। তার চেয়ে ফিল্ডে কাজের সময় বৈশ্বিক সহায়তা তাৎপর্য বহন করে। এজন্য উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা, চায়না, জার্মানি, ফ্রান্স বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে।
বেলাল: করোনাভাইরাস মহামারি অভিজ্ঞতা থেকে পৃথিবীকে বাস-উপযোগী রাখতে কী ধরনের শিক্ষা নেওয়া উচিত মানুষের?
শফি মুহাম্মদ: প্রত্যেক ক্রিয়ার বিপরীত ক্রিয়া আছে। পৃথীবির রিসোর্সকে যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করলে ফল ভালো হয় না। সেটা আজ প্রমাণিত। করোনাভাইরাস দেখিয়েছে কী করে বন্যপ্রাণীর ক্ষতিসাধন মানবসভ্যতাকে স্থবির করে দিতে পারে। আমাদের প্রধান শিক্ষা হওয়া উচিত সহনশীলতা ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার।
বেলাল: পরিবেশবাদীরা মানুষকে কতটুকু সচেতন করতে সক্ষম হচ্ছে?
শফি মুহাম্মদ: ধরিত্রী দিবস থেকে সম্মেলন সবকিছুই পরিবশেবাদীদের অবদান। এ কারণেই পৃথীবিব্যাপী একটা ভাইব তৈরি হয়েছে পরিবেশ সচেতনতার ওপর। কাজের এখনো সুযোগ রয়েছে। বিশেষত ব্যক্তি পর্যায়ে সারা বিশ্বে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারে তাঁরা। এবং পরিবেশ আন্দোলনকে প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।
বেলাল: বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা সবাই একমত জলবায়ু পরিবর্তন আসলে মানবসৃষ্ট কারণে ঘটে। কিন্তু এরপরেও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ আছে। এ ধারণা পোষণ করেন অনেক রাষ্ট্রনেতা। এবিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?
শফি মুহাম্মদ: শিল্পায়নের পূর্বেই পৃথীবিতে বেশ কয়েকবার র্যাডিকাল ক্লাইমেট চেঞ্জ হয়েছে। এখন সেটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে জলবায়ুতে নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাব। আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এ বিষয়ে আপত্তি তোলে। এবং জাতিসংঘের জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। সেটা কয়েকজন পরিবেশ বিজ্ঞানীর মেইল ফাঁস ইস্যুকে কেন্দ্র করে। যেটা অত্যন্ত হাস্যকর। আশার কথা বর্তমান আমেরিকার অধিপতি চুক্তিতে ফিরে এসেছে। তাদের মতো সুপারপাওয়ারের সহযোগিতা ছাড়া এধরণের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার সফলতা দূরুহ ব্যাপার।
বেলাল: পরিবেশ আন্দোলনসমূহ অন্যান্য নাগরিক আন্দোলনের মতো জনসংযোগে ব্যর্থ কেন? এর দায় আসলে কার।
শফি মুহাম্মদ: দোষ দু’পক্ষেরই আছে। জনগণ পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে পরিবেশবাদীরা নিরুৎসাহিত হয়। অবৈতনিকভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নিয়মিত লড়াই করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।