ধর্মের সাথে নারীবাদের বিরোধিতা নেই: মির্জা তাসলিমা সুলতানা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা। নেদারল্যান্ডসের উত্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয় নারী ও রাজনীতির তুলনামূলক পাঠ এবং জার্মানির হ্যানোভারের আন্তর্জাতিক নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীর’ নিয়ে উচ্চতর অধ্যয়ন করেছেন। তিনি শরীর ও অসুস্থতা, লিঙ্গীয় সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং সংস্কৃতির অধ্যয়ন নিয়ে গবেষণা করেন।
পেশাগত জীবনে প্রথমে বাংলা একাডেমিতে জুনিয়র ফেলো হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৯৪ সালে আইসিডিডিআর,বি; ১৯৯৫ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং ১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগাদান করেন অধ্যাপক তাসলিমা। মহামারিতে নারী সহিংসতা এবং নারীর আর্থ-সামজিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে অধ্যাপক তাসলিমার সাথে কথা বলেছেন বেলাল হোসেন
বেলাল হোসেন: মহামারি ও নারী নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ।
অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা: প্রত্যেক শতাব্দীতে মহামারি হয়েছে। আর সংকট সময়ে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এবারও তাই লক্ষ্য করছি। পেশাজীবি নারীরা তাদের সহকর্মীর তুলনায় আন্তরিকতার সাথেই দায়িত্ব পালন করছে। তবে অনেকেই আবদ্ধ রয়েছে। এতে সহিংসতার সাথে হতাশা ও বিষন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারটি আমাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ।
বেলাল হোসেন: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মহামারিতে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র এর প্রতিকারে আইন প্রণয়ন করছে। তবুও সহিংসতা রোধ করা যাচ্ছে না। এর মূলে কী রয়েছে?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার দায় শুধুমাত্র পরিবার কিংবা সমাজের নয়। এখানে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্ব রয়েছে। কারণ আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। সমাজে নারীর কাজ করার পরিসর রয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু এ কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক হওয়ায় সমস্যাটি জটিল আকার ধারণ করে। মহামারিতে আবদ্ধ থাকার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করলেই হবে না। আইন প্রয়োগের আগেই অপরাধের কারণ অনুসন্ধান পূর্বক প্রতিরোধ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সহিংসতা রোধে নারীর স্বনির্ভর মানসিকতা কতটুকু কার্যকর?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নারীর স্বনির্ভর মানসিকতা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়। স্বনির্ভতার পূর্বে নিরাপদ পরিবেশ প্রয়োজন। তবেই স্বনির্ভর নারীরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সাহসের মাধ্যমে নিজের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে।
বেলাল হোসেন: মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি পরিবারের প্রত্যাশা ও পরিবারের প্রতি নারীর প্রত্যাশা কতটুকু বৈপরীত্য বহন করছে?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: মহামারি নারীকে উৎপাদন কাঠামোতে আরো বেশী জড়িত করেছে। পরিবারে একজনের উপার্জন যথেষ্ট না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি। একই সাথে নারীকে তাঁর পরিবার সামলাতে হচ্ছে। বিপরীতে একজন পুরুষ উপার্জন করলেও সন্তান লালন-পালনের বৃহৎ দায় নারীর ওপরেই থাকে। ফলে পরিবারগুলোয় একটি জাতীয় সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।
বেলাল হোসেন: মহামারিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীত্ব বা মাতৃত্বের প্রতি সর্বজনের মনন, মানসিকতাকে কিভাবে অভিহিত করতে চান।
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবার ভেদে, ব্যক্তি ভেদে নারীত্ব ও মাতৃত্বের প্রতি পার্থক্য তৈরি করে। পার্থক্য সমাজ ছাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বজনের মনন, মানসিকতাকে প্রভাবিত করে। ফলে দেখা যায় কেউ ধর্মের কারণে নারীকে নির্যাতন করছে। আবার অনেকে ধর্ম চর্চায় নারীকে ভালোবাসছে, সেবা করছে। ধর্ম, সম্প্রদায় সকল ক্ষেত্রে নারীর স্বাতন্ত্রিক মর্যাদা আছে। এর চর্চা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। তাই মনন, মানসিকতায় ভেদাভেদ তৈরি হয়।
বেলাল হোসেন: নারীকে বৈধভাবে উপভোগ করা ও কাজে লাগানোর বিষয়ে ধর্ম, প্রচলিত মতবিশ্বাসের সাথে নারীর মৌলিক অধিকার কতটুকু সাংঘর্ষিক।
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: এটা সরলীকরণ হিসেব নয়। এ অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়, ধর্মবিশ্বাসে খুব বেশী নারী বিরোধী কিছু নয়। যেমন: ইসলামে নারীকে বঞ্চণা করা হয়নি। কিন্তু এর চর্চাকারীদের ওপর নির্ভর করছে নারীর মৌলিক অধিকার। আসলে ধর্মের সাথে নারীবাদের বিরোধিতা নেই। এটা সেক্যুলারদের একরোখা দৃষ্টিভঙ্গি। এটা এক ধরনের ঔপনিবেশিক ধারণা। এ মানসিকতার কারণে সম্প্রদায়গুলোর মনোজগতে গণসংযোগ সম্ভব হয় না। ধর্মকে প্রশ্ন করতে হবে কিন্তু কুৎসা রটানো যাবে না। না, হলে এটা আরো অমঙ্গল ডেকে আনবে।
বেলাল হোসেন: নারীবাদ নারী পুরুষ উভয়কেই লাভবান করে। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের যাতাকল থেকে পুরুষের মুক্তির কথা বলে। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করবেন কিভাবে?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: পুরুষতন্ত্র শব্দটিতে আমার আপত্তি রয়েছে। আসলে এটা পিতৃতান্ত্রিক হবে। যার মাধ্যমে উত্তরাধিকারী নির্ধারিত হয়। নারীবাদ সকল মানুষের মুক্তির কথা বলে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বলে, এথনিক ক্লিনজিংয়ের বিরুদ্ধে বলে, সকল প্রকার শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীবাদের অবস্থান রয়েছে। নারীবাদ আমাদের চিন্তাকে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু অনেকেই তা স্বীকার করে না। যদিও কর্মকাণ্ডে নারীবাদের ঐকতান থাকে। এর কারণ হচ্ছে নারীবাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো। নারীবাদ প্রচলিত বাস্তবতাকে জোড়ালো ধাক্কা দেয় পরিবর্তনের জন্য। এ কারণে সেটি অনেকের চক্ষুশূল। তথাপি নারীবাদ তার কাজ জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চা করে চলেছে। জ্ঞান কখনো কারো দিকে তাকিয়ে তৈরি হয় না। আর এটা সকলের জন্য সুখকর হয় না। এজন্য নারীবাদকে জনপ্রিয়তা অর্জন করার প্রয়োজন পরে না। নারীবাদ জ্ঞানের কাজ করে করে সমাজে ধাক্কা দিয়ে চলেছে। অন্যের মন রক্সা করে তো সেটা সম্ভব হবে না।
বেলাল হোসেন: করোনায় নারী, পরিবার ও রাষ্ট্র নিয়ে পর্যালোচনা?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: একজন নারী উপার্জন করলেও রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিচ্ছে না। আবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি পরিবারের সন্তানও দেখভালো করে না। কোন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ বিপথগামী হলে সেই দায় পরিবারের প্রকারান্তরে মা’য়ের। এখন একজন মা কত কিছু করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর দায় কেনো পরিবারকে নিতে হবে। রাষ্ট্র যদি তাঁর ভবিষ্যৎ নাগরিককে দেখভাল না করে তবে তা রাষ্ট্রের হুমকি। এ কারণেই দেশে সুনাগরিক তৈরি হচ্ছে না।
বেলাল হোসেন: নগরের নারীর সাথে গ্রামীণ নারীর অধিকার আন্দোলনের মৌলিকত্ব কি? যেখানে একজন মা’কে উদয়াস্ত বিনা মজুরির শ্রম আর দাসজীবনের আর্তি নিয়ে বাচতে হয়।
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: গ্রামীণ কিংবা নগর নারী বলে নারীর কোন পার্থক্য বা সমরূপ হয় না। গ্রামীণ নারীরা সাংসারিক কাজ করে। অনেক সময় পরিচালনাও করেন। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীরাও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করে। সেই সাথে অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। কিন্তু সেই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে নগরের নারীর তুলনায় তাঁরা উপেক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে মৌলিকত্বের কিছু নেই। আন্দোলনের ব্যাপ্তি সর্বজন হওয়ায় উচিত। যারা মৌলিকত্বের কথা বলে তারা দু’পাতা বিদ্যাচর্চার কারণে।
বেলাল হোসেন: বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নারীরা কি সমাজের নিপীড়িত নারীর জন্য পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে?
মির্জা তাসলিমা সুলতানা: নারীবাদে এটা সরল সমীকরণ নয়। যে সকল পুরুষ নির্যাতক আর নারী নির্যাতিত। অনেক সময় পুরুষও নারী দ্বারা নির্যাতিত, বঞ্চিত কিংবা প্রতারিত হতে পারে। আসলে পুরো ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হওয়াতে প্রতিষ্ঠিত নারীরাও সেই তন্ত্রের অংশ। ফলে এ গোষ্ঠী রাষ্ট্র দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও নারীত্বের মর্যাদায় গুরুত্ব রাখে না। তারা চাইলে কাঠামো পরিবর্তনে অংশ নিয়ে নিপীড়িতদের জন্য ভূমিকা রাখতে পারে।